তৃতীয় অধ্যায়
এই অধ্যায়ে বিভিন্ন লেখকের কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযুক্ত করা হবে। প্রথম দু’অধ্যায়ের লেখাগুলো পাঠকদের ভালো না লাগলেও এ অধ্যায়ের লেখাগুলো ভালো এবং উপকারি মনে হতে পারে, কারণ এগুলো যে প্রথিতযশা লেখকদের।
এই শতাব্দীর বিজ্ঞান : এডউইন হাবলস আইনস্টাইন এবং আল্লাহর অস্তিত্ব
মো বা য়ে দু র র হ মা ন
চলতি শতাব্দী তথা চলতি সহস্রাব্দের একেবারে খাড়া কিনারে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞান এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে : এই শতাব্দীতে বিজ্ঞান কি মানুষকে ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে? নাকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে ধর্মের আরো কাছে টেনেছে? আমার যখন জ্ঞান-বুদ্ধি হতে শুরু হয় তখন উঠতি শিক্ষিতদের বলতে শুনেছি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার ধর্মের মূলোৎপাটন করছে।
শিক্ষার আলো, বিশেষ করে জ্ঞানের আলো যতই ছড়িয়ে পড়ছে ততই অজ্ঞানতা এবং কুসংস্কারের অন্ধকার দূর হচ্ছে। এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হলেন আইনস্টাইন, নিউটন প্রমুখ এবং হাল আমলের স্টিফেন হকিং। সেই আইনস্টাইন বলছেন, Science without religion is lame, but religion without science is blind. অর্থাৎ ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান হল খোঁড়া, কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম হল অন্ধ। আইনস্টাইনের এই উক্তি মোটামুটি অনেকেই জানেন। কারণ এই উক্তি এই মহাবিজ্ঞানী ৫০ দশকে করেছিলেন। তখন এই উক্তি সারা দুনিয়ায় প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। কারণ বিস্ময়কর সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে সাথে ধর্মের বারোটা বাজলো বলে এক শ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তি উল্লাস করছিলেন। তখন আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানী-শিরোমণির সেই উক্তি তাদের উল্লাসে হঠাৎ ভাটা এনে দিল।
আবার সেই আইনস্টাইন যখন বললেন, Imagination is more important than knowledge. তখন গবেষক এবং পণ্ডিতরা থমকে দাঁড়ালেন। কারণ জ্ঞান দু’ভাবে আহরণ করা যায়। একটি হল ব্যাপক পড়াশোনা এবং গবেষণা। আরেকটি হল ইমাজিনেশন বা কল্পনা। আইনস্টাইন কল্পনাকে জ্ঞানের উর্ধ্বে স্থান দিলেন কেন? আজ সময় এসেছে এসব নিয়ে গভীরভাবে ভাববার।
চন্দ্রে অবতরণ এবং বাট্রান্ড রাসেল
১৯৬৯ সালে নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং চন্দ্রে অবতরণ করেন। নিঃসন্দেহে এটি এই সহস্রাব্দের একটি ল্যান্ড মার্ক। বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কর উন্নতিতে সারা বিশ্বে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল। এটা হয়ে ছিল যথার্থভাবেই। অবশ্যই এটা প্রশংসার দাবীদার । কিন্তু কিছুসংখ্যক মতলববাজ শিক্ষিত লোক চন্দ্রে অবতরণের ঘটনাকে ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা শুরু করে দিল। চাঁদে অবতরণের সাথে ধর্মের সত্য-মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার সম্পর্ক কোথায়- সেটা মোটেই বোধগম্য নয়। তৎসত্ত্বেও তারা যখন এসব নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করছিল তখন আরেক মনীষী বলে উঠলেন ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ জামাল নজরুল ইসলামের একটি নিবন্ধ থেকে ঐ উক্তিটি জানা যায়। জনাব নজরুল ইসলামের এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে চলতি সালের ১০ নভেম্বর ‘ডেইলী স্টারে’। তার এই নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে, এই শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তিনি বিখ্যাত ‘লন্ডন টাইম্স’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। চাঁদে অবতরণ নিয়ে তখন সারা দুনিয়া জুড়ে চলছে প্রচন্ড হৈ-চৈ। এই হৈ-চৈকে লক্ষ্য করে বাট্রান্ড রাসেল তাঁর এই নিবন্ধে বলেন, Mankind should spend more time on quiet contemplation rather than bustling activity and this is perfectly natural. But it is the quiet contemplation that produces great works of art, literature, philosophy, science and other fields, which are not just meaningful to an elite, but these help to create and sustain a civilization and give it long term stability. অর্থাৎ “মানব জাতির উচিত হৈ-হুল্লোড় না করে নীরব ধ্যান বা চিন্তা ভাবনায় অধিক সময় ব্যয় করা। মানুষের প্রবণতাই হল হৈচৈ করা। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ঐ নীরব ভাবনা বা ধ্যান মহৎ কর্মের জন্ম দেয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য ক্ষেত্র। সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মানুষের কাছে এগুলো হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে সভ্যতার জন্ম দেয়া, তাকে লালন পালন করা এবং তাকে দীর্ঘ স্থায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন ইত্যাদি বিরাট ভূমিকা রাখে।”
বাট্রান্ড রাসেলের এই উক্তির সাথে আমরা আইনস্টাইনের উক্তির অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করি। আইনস্টাইনের উদ্ধৃতি আগেই দেয়া হয়েছে যেখানে তিনি বলেছেন যে, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা বেশী অর্থবহ। আসলে কল্পনা বা নীরব ভাবনার মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান বা শাশ্বত সত্য আবি®কৃত হয়। এই কথাটি আরো বেশী করে প্রযোজ্য আইজ্যাক নিউটনের ক্ষেত্রে।
মধ্যাকর্ষণ শক্তির গোড়ার কথা
দুনিয়াবাসী এতদিন জেনে এসেছে যে, আইজ্যাক নিউটন একটি আপেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি আপেল বৃন্তচ্যুত হয়ে মাটিতে পড়ল। নিউটন ভাবলেন ফলটি মাটিতে না পড়ে উপরের দিকে গেল না কেন? কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, ঘটনাটি ঐভাবে ঘটেনি এবং স্যার নিউটনও ঐ পদ্ধতিতে ভাবেননি। বিষয়টি নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। ধ্যানের জগতে তিনি ঐসব চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। এই শতাব্দীর নিউটন বলে যাকে অভিহিত করা হয় সেই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বিষয়টি বিধৃত করেছেন এভাবে, ''Newton postulated a law of universal gravitation according to which each body in the universe was attracted toward every other body by a force that was stronger than more massive the bodies and the closer they were to each other. It was this same force that caused objects to fall to the ground. The story was that an apple hitting his head as almost certainly apocryphal inspired Newton. All Newton himself ever said was that the idea of gravity came to him as he sat in a 'contemplating mood’ was occasioned by the fall of an apple." অর্থাৎ নিউটন মধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এই সূত্র অনুযায়ী মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ(ইড়ফু) অপর গ্রহকে আকর্ষণ করছে। কে কাকে আকর্ষণ করবে সেটা নির্ভর করছে দু’টি বিষয়ের উপর। যে গ্রহটি বেশী বড় এবং কাছে সেই গ্রহটি তত বেশী শক্তিশালী এবং অপেক্ষাকৃত কাছের গ্রহকে আকর্ষণ করছে। এই শক্তির কারণেই কোনো বস্তু মাটিতে পড়ে। কথিত আছে যে, নিউটনের মাথার ওপর একটি আপেল পড়ে এবং তাকে আঘাত করে। এই কাহিনীর সত্যতা সম্পর্ক অবশ্যই সংশয় আছে। (তথ্য সূত্র: Stepen Hawking : A brief history of time : Page 5)। উল্লেখ করা যেতে পারে ইনিই সেই স্টিফেন হকিং, যার প্রতি লন্ডনের ‘ডেইলী এক্সপ্রেস’ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে এভাবে, "One of the most brilliant scientific mind since Einstine"। আর এটাই হল সেই অমর গ্রন্থ, যেখানে বিধৃত আছে সমুদয় তথ্য, যেটাকে তারা বর্ণনা করেছে এভাবে, "From the Big Bang to Black Holes".
দুই.
ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ যারা বাঁধিয়েছেন, সেই সংঘর্ষের অন্যতম হোতা হলেন চার্লস ডারউইন। তাঁর প্রজাতির জন্মতত্ত্বে (Origin of species) তিনি বলেছেন যে, মানব জাতি আদিতে ছিল বানর। বিবর্তনের মাধ্যমে তারা বর্তমান পর্যায়ে অর্থাৎ মানুষের চেহারায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই তত্ত্বটি ধর্মের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বাইবেল এবং কোরআন শরীফ উভয় ঐশী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, আদি পিতা হলেন হযরত আদম আ.। তাঁর পাঁজর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বিবি হাওয়াকে। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ফলে তাদেরকে বেহশ্ত থেকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম মানব যদি হন হযরত আদম, তাহলে সেখানে বানরের কোনো স্থান নেই। আসলে ডারউইনের থিওরী বাতিল হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোথাও এই থিওরী আর গ্রহণযোগ্য নয়।
হযরত নূহের কিস্তি এবং সাম্প্রতিক আবিষ্কার
পবিত্র কোরআন এবং বাইবেলে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) উল্লেখ আছে যে, আল্লাহ্ তাআলা মানুষের পাপাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে হযরত নূহ আ.-এর দেশে মহাপ্লাবন এনে দেন। এই প্রলয়ঙ্করী বন্যা থেকে বাঁচার জন্য একটি কিস্তি (নৌকা) মওজুদ রাখা হয় এবং হযরত নূহকে আ. সপরিবারে ঐ নৌকায় উঠতে বলা হয়। বলা হয় যে, যেখানে এই মহাপ্লাবন হয়েছিল সেটা এখন আটলান্টিক মহাসাগর। হযরত নূহ আ. ঐ কিস্তিতে উঠে বেঁচে গেলেন। কিন্তু সেদেশের মানুষ বন্যার তোড়ে ভেসে গেল অথবা ডুবে মারা গেল। অবাক ব্যাপার হল এই যে, ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে ইতিহাসবেত্তা এবং বিজ্ঞানীরা একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছেন। ঐ তথ্যে দেখা যায় যে, আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা একটি সর্বগ্রাসী বন্যার পানিতে ভেসে গিয়েছিল। ঐ ঘটনাটি ঘটেছিল ১০ হাজার বছর আগে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল এই যে, বাইবেল এবং কুরআন শরীফে বর্ণিত নূহের (আ.) প্লাবনটিও ঘটেছিল ১০ হাজার বছর পূর্বে। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মিত্রবাহিনীর বোমারুবিমানগুলো তুরস্কের আরারাত পর্বতের ওপর উড়ে যাওয়ার সময় এই জলযান বা কিস্তিকে শনাক্ত করেছে। এই জলযান বা নৌকা বিশাল হিমবাহের তলে চাপা পড়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঐ মহাপ্লাবনের ধ্বংসাবশেষ আটলান্টিকের তলদেশে আবি®কৃত হচ্ছে। ‘সোনার’ (Sonar) নামক যন্ত্র এই ধ্বংসাবশেষের সন্ধান দিচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সোনার নামক যন্ত্রের সাহায্যে পানিতে শব্দ তরঙ্গ প্রতিফলিত হয় এবং নিমজ্জিত বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করা যায় এবং তার সন্ধান পাওয়া যায়।
মহাবিশ্বের ক্রমসম্প্রসারণ
বিজ্ঞানের জটিল সূত্রে যাব না। খুব সহজ ভাষায় বলার চেষ্টা করছি। পৃথিবীর আয়তন আছে, তেমনি আছে চাঁদের। কিন্তু যে মহাবিশ্বের বুকে অন্তত ২০ হাজার কোটি ছায়াপথ তথা গ্রহ-নক্ষত্র ভেসে বেড়াচ্ছে বা ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই মহাবিশ্বের আয়তন, আকৃতি, পরিধি বা ব্যাস কত? কেউ বলতে পারে না, পারবেও না কোনোদিন। কারণ মহাবিশ্ব ক্রমশ বেড়েই চলছে। সাদামাটা ভাষায় বললে বলতে হয়। বেলুনের মত, রাবারের মত বা ইলাস্টিকের মত বেড়েই চলছে। বাড়তে বাড়তে কত বড় হয়েছে সেটা কেউ জানে না। এই যে মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে সেটাকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়েছে Expanding Universe বা সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব। এই সম্প্রসারণশীলতার কথা বলেছিলেন আইনস্টাইন। এর পর জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল্স একটি সুপার টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে প্রমাণ করলেন যে, মহাবিশ্ব দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে। ঐ টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি দেখলেন এবং দেখালেন যে, আজ একটি গ্রহানুপুঞ্জ মহাশূন্যের যে স্থানে অবস্থান করছে, কিছু দিন পর সেই গ্রহানুপুঞ্জ অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। এই যে সরে যাচ্ছে তার গতি আলোর গতির চেয়েও বেশী। আপনারা হয়তো জানেন যে, আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। তাহলে বুঝে দেখুন, অনেক গ্রহানুপুুঞ্জ সরে যাচ্ছে, ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পেছনে। সরে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে। অন্যকথায় বলা যায় যে, মহাবিশ্বের সীমানা বৃদ্ধি পাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মাইল বেগে। এই ঘটনাটি ঘটছে আনুমানিক ১ হাজার ৯শ’ কোটি বছর আগ থেকে। কিন্তু সেটি একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেল মাত্র ৬৬ বছর পূর্বে, ১৯৩৪ সালে।
কিন্তু কী আশ্চর্য, এই যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যেটা প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ৬০-৭০ বছর আগে, সেটাই কোরআন শরীফে বলা হয়েছে ১৫শ’ বছর আগে। সূরা আত্-তাকবীরের ১৫ ও ১৬ আয়াতে বলা হয়েছে : So verily I call to witness the planets that recede, Go straight or ltide অর্থাৎ “আমি শপথ করি যে, তোমরা ঐ নক্ষত্রসমূহ অবলোকন কর যেগুলো পেছনে সরে যায়, চলমান হয় এবং অদৃশ্য হয়।”
দেড় হাজার বছর আগে এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? আল্লাহর রাসুল তো লেখাপড়া জানতেন না। তখন তো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও তো আবিষ্কৃত হয়নি । সুনিশ্চিতভাবে এসব অনন্ত সত্য বলিয়েছেন সেই সর্বজ্ঞ, সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্। তিনি বলেছেন হযরত জিব্রাইলের মাধ্যমে। দেড় হাজার বছর আগে যখন মহাবিশ্বের এই জটিল সূত্র কোরআন শরীফের মাধ্যমে এসেছে তখন অবশ্যই সেটা ঐশী গ্রন্থ, আসমানী কিতাব।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, হাবল্স বা আইনস্টাইনের বিজ্ঞান কেন্দ্রাভিমুখে ছুটছে, কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করছে না। শুধু সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বই নয়; আরো অসংখ্য বৈজ্ঞানিক সূত্র আল্-কোরআনের মূল নীতিকে জোরদার করছে। কোরআন শরীফ অশিক্ষিতদের গ্রন্থ নয়। কোরআন শরীফ উচ্চশিক্ষিতদের গ্রন্থ। যতই দিন যাবে ততই নতুন আবিষ্কার সেই কেন্দ্রের অস্তিত্ব এবং তার নিয়ন্ত্রণ বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করবে। সেই কেন্দ্র হল এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ্। (ঈষৎ সংক্ষেপিত) [দৈনিক ইনকিলাব, ০১ জানুয়ারী ২০০০ সংখ্যায় প্রকাশিত।]
কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান
ড. ম রি স বু কা ই লী
[অনুবাদঃ আখ্তার-উ্ল-আলম]
কোরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যে যে সর্ম্পক তা প্রাথমিক যে-কোনো বিচারে বিস্ময়কর। বিশেষত যখন দেখতে পাওয়া যায় যে, কোরআনের সাথে বিজ্ঞানের সর্ম্পক বিরোধের নয় বরং সে সর্ম্পক বিস্ময়করভাবে মিল-মিছিলের। আধুনিক যুগে অনেকের চোখেই ধর্মশাস্ত্রের সাথে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার সর্ম্পক অনেকটা যুদ্ধংদেহী। বিষয়টি যতই আপাতসত্য হোক, দেখা যাচ্ছে, অধুনা বিজ্ঞানও এই ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেকুলার ভাবধারার কথাই বলে থাকে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেকুলার ভাবধারার সাথে ধর্মীয়শাস্ত্রের সর্ম্পক অনেকটাই বিরোধপূর্ণ। তা ছাড়া এ কথাটিও সত্য বলে মানতে হয় যে, আজকের যুগের বেশিরভাগ বিজ্ঞানী বস্তুবাদী-থিওরি তথা চিন্তাধারার সাথে অধিক মাত্রায় সম্পৃক্ত। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছেন; তবে তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি নন। এই নগণ্যসংখ্যক বিজ্ঞানীর কথা বাদ দিলে বেশিরভাগ বস্তুবাদী মনোভাবসম্পন্ন বিজ্ঞানীকে দেখা যায়, তাঁরা যখন প্রচলিত কোনো কাহিনী কিংবা উপকথায় ধর্মীয় কোনো প্রশ্ন দেখতে পান, তখন সে বিষয়ে তাঁরা শুধু অনাগ্রহ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেন না, অবজ্ঞাও প্রদর্শন করেন।
এদিকে পাশ্চাত্য জগতে ধর্ম আর বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে যখন কোনো আলোচনা চলে, তখন সবাই সাধারণত ধর্ম বলতে ইহুদী ও খ্রীস্টধর্মের কথা বুঝে থাকেন ও বলে থাকেন। ঘুণাক্ষরেও কেউ ইসলামের কথা ভাবেন না বা বলেন না। তা ছাড়া ইসলাম সর্ম্পকে পাশ্চাত্যে এত বেশি ভুল-ব্যাখ্যা ও ভিত্তিহীন ধারণা গড়ে উঠেছে যে, ইসলামের আসল রূপ যে কি, সে সর্ম্পকে সঠিক তত্ত্ব উপস্থাপন সত্যি কঠিন।
সুতরাং ওহী বা ইসলামী ঐশীবাণীর সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ আছে কি নেই -- সে সম্বন্ধে কোনো কিছু বলার আগে ইসলাম ধর্মের রূপরেখা সম্পর্কে আবশ্যিকভাবেই একটা ভূমিকা দিতে হয়। তা ছাড়া পাশ্চাত্য জগতে ইসলাম ধর্ম এত কম পরিচিত যে, এ ধরনের একটা ভূমিকা না দিয়ে উপায়ও থাকে না।
অধুনা পাশ্চাত্য জগতে (এবং আধুনিক শিক্ষিতসমাজে) ইসলাম সম্পর্কে যে ধারণা গড়ে উঠেছে, তা সর্বতোভাবে ভ্রান্তিপূর্ণ। আর ইসলাম সম্পর্কে এই ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা গড়ে উঠেছে-প্রথমত, অজ্ঞতার দরুন; এবং দ্বিতীয়ত, এই ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়েছে--ইসলামকে সুপরিকল্পিতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য যে, ইসলাম ধর্মের কোনো সত্যি ঘটনা সম্পর্কেও যখন কিছু বলা হয় বা লেখা হয়, দেখা যায়, মিথ্যাচার চলে সেখানে সবচেয়ে বেশি মাত্রায়। অথচ স্বীকার না করে উপায় নাই যে, কোনো বিষয়ে প্রদত্ত কোনো মতামত অসত্য হলে তা উপেক্ষা করা যেতে পারে; কিন্তু জেনেশুনেই যখন কোনো বাস্তব ও সত্য ঘটনা বিকৃত করা হয়- তখন তা ক্ষমার অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই, কোনো লেখক তাঁর রচনায় যখন ইসলাম সম্পর্কে এ ধরনের অসত্যের বেসাতি করেন, তখন অবশ্যই খারাপ লাগে। আর সেই লেখক যদি সর্বজনস্বীকৃত কোনো পণ্ডিতব্যক্তি হন এবং তাঁর সেই রচনা যখন সকল মহলের নিকট সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে থাকে, তা হলে সেই খারাপ-লাগার মাত্রাটাও তখন বৃদ্ধি না পেয়ে পারে না।
নিচে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ইউনিভার্সালিস’-এর ৬ষ্ঠ খণ্ড থেকে এমনি একটি রচনার ঊদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে। ‘গসপেল’ বা ‘সুসমাচার’ র্শীষক অধ্যায়ে লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআনের সাথে সুসমাচারসমূহের (ইঞ্জিল ১-৪ খণ্ডের) পার্থক্য তুলে ধরেছেন এভাবে : “সুসমাচারের লেখকবৃন্দ . . . কস্মিনকালেও . . . কোরআনের মত এই দাবি করেন নি যে, স্রষ্টা স্বয়ং অলৌকিক উপায়ে পয়গম্বরের নিকট একখানি জীবনী-গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন।’’. . . আসলে কিন্তু কোরআন আদৌ কোনো জীবনী-গ্রন্থমূলক রচনা নয়; বরং কোরআন হল ওহী বা প্রত্যাদেশপূর্ণ প্রচার-বাণী। লেখক যদি একটু কষ্ট স্বীকার করে কোরআনের যে-কোনো একখানা অনুবাদ দেখে নিতেন, তা হলে--সে অনুবাদ যতই অক্ষম বা যতই খারাপ হোক না কেন, তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারতেন, কোরআন সম্পর্কে তাঁর ধারণা কতটা ভ্রান্তিপূর্ণ।
বস্তুত উপরে কোরআন সম্পর্কে উক্ত এনসাইক্লোপিডিয়া-লেখকের যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, সে বক্তব্য আসল সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। আজ যদি কেউ রায় দিয়ে বসেন যে, সুসমাচারসমূহ হচ্ছে সুসমাচার-লেখকদেরই জীবনী মাত্র, তা হলে সেটা যেমন অসত্য হবে, ঠিক তেমনি অসত্য ও ভিত্তিহীন হচ্ছে কোরআন সম্পর্কে উপরোক্ত রায় বা মন্তব্য। অথচ আলোচ্য এনসাইক্লোপিডিয়ায় কোরআন--সম্পর্কিত এই অসত্য-বক্তব্যের লেখক যেমন-তেমন কেউ নন--বরং এই লেখক লিওনের (বিশ্ববিদ্যালয়) জেসুইট ফ্যাকাল্টির একজন অধ্যাপক। এঁদের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তি যখন অবলীলায় এ ধরনের অসত্য বক্তব্য পাঠকদের উপহার দেন, তখন ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে যে ভুল ধারণা গড়ে উঠবে, তাতে আর বিচিত্র কি!
অধুনা অবশ্য কিছুটা আশার আলো দেখা দিতে শুরু করেছে। কেননা, ধর্ম এখন আর শুধু মনে-মনে বিচার-বিবেচনা করার বিষয় হয়ে থাকছে না,-- ইদানীং অনেকেই ধর্মকে পারস্পরিক সমঝোতার উপায় হিসেবেও দেখতে শুরু করেছেন। যে-কেউ জেনে খুশি হবেন যে, ইদানীং রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মীয় সর্বোচ্চ-পর্যায়ে ইসলামের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রয়াস চলছে। বরং বলা চলে, সেখানে ইসলামকে বুঝবার ব্যাপারে চলছে এক আন্তরিক প্রয়াস। শুধু তাই নয়, ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপকভাবে যে ভুল ধারণা গড়ে উঠেছে, সেই ভ্রান্তি নিরসনের জন্যও এই মহল প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে।
এ পুস্তকের গোড়াতেই আমি এর একটা আভাস দিয়েছি। দেখাবার প্রয়াস পেয়েছি, কিভাবে গত কয়েক বছরে ভাটিক্যানের ‘নন-ক্রিশ্চিয়ান এ্যাফেয়ার্স’ দফতর থেকে ইসলাম সম্পর্কে এ ধরনের সদিচ্ছামূলক বক্তব্য-সম্বলিত দলিল প্রকাশ করা হয়েছে। উপরে আমি তার উদ্ধৃতিও তুলে ধরেছি। এসব দলিল বাস্তবিকই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এগুলিতে দেখা যাচ্ছে, কিভাবে ক্যাথলিক-মহলে ইসলাম সম্পর্কে নবতর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে। ভাটিক্যান থেকে প্রকাশিত এতদ্সংক্রান্ত দলিলের তৃতীয় সংস্করণটিতে (১৯৭০) ইসলাম সম্পর্কে খ্রীস্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধনের এবং মনগড়া ধারণা ও প্রচলিত সংস্কারের ব্যাপারে আত্মসমালোচনামূলক নিরীক্ষার আবেদন জানানো হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, “এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ব্যাপারে সবার আগে খ্রীস্টানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। . . .
ইসলাম সম্পর্কে অতীতের সেই পুরাতন ভাবধারা--যা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি--এবং সংস্কারবশত ইসলামের প্রতি আমাদের যে বিদ্বেষমূলক মনোভাব ও ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা--তা আজ আমাদের ঝেড়ে-মুছে ফেলতে হবে।” এবং “স্বীকার করতেই হবে যে, অতীতে ইসলামের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে,--আর এই অন্যায়ের জন্য দায়ী হল পাশ্চাত্য জগৎ, বিশেষত তার খ্রীস্টীয়-শিক্ষাব্যবস্থা।’’
যাহোক, ভাটিক্যানের উক্ত দলিল বা ইশ্তেহারের পৃষ্ঠাসংখ্যা হচ্ছে প্রায় দেড়শত। এতে ইসলাম সম্পর্কে খ্রীস্টানদের চিরাচরিত ধারণার খণ্ডন ছাড়াও ইসলামের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিগ্রহণের প্রয়াস পরিদৃশ্যমান।
‘ইমানসিপেটিং আওয়ারসেল্ভ্স্ ফ্রম আওয়ার ওয়ার্স্ট প্রেজুডিসেস’-- অর্থাৎ ‘জঘন্যতম কুসংস্কার থেকে নিজেদের মুক্তি’ শীর্ষক এই দলিলের লেখকবৃন্দ খ্রীস্টানদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা নিম্নরূপ : ‘‘এই পর্যায়ে আমাদের অবশ্যই একটা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষত এই পর্যায়ে আমরা একটা বিষয়ের উপরে গুরুত্ব আরোপ করছি। আর তা হল, ইসলাম সম্পর্কে আমরা আমাদের মনের মধ্যে এক ‘চিরাচরিত বিবেচনা’ জিইয়ে রেখেছি এবং ইসলাম সম্পর্কে যখন-তখন যেন-তেন প্রকারে সেই বিভ্রান্তিকর মতামত প্রকাশ করেও চলেছি। আমাদের উচিত হবে, অন্তরের অন্তস্থলে ইসলাম সম্পর্কে এরকম কোনো ধারণা পোষণ না করা--এবং সে ধারণা যাতে এরকম সহজিয়া ও একতরফা না হয়, সেদিকে আবশ্যিক দৃষ্টি রাখা। কেননা, এরকম প্রচারণার দরুন নিষ্ঠাবান মুসলমান মাত্রই আমাদের ভুল বুঝে থাকেন।’’
বলা অনাবশ্যক যে, এরকম একটা ধারণার দরুন পাশ্চাত্যের অনেকেই ‘আল্লাহ্’ শব্দটিকে কেবল মুসলমানদের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ব্যবহার করে চলেছেন। ভাবখানা যেন এই যে, মুসলমানরা যে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস রাখেন, তিনি খ্রীস্টানদের সৃষ্টিকর্তা থেকে আলাদা! আসলে, ‘আল্লাহ্’ শব্দের দ্বারা আরবীতে সেই পরম স্রষ্টাকেই বোঝানো হয়ে থাকে, যিনি একক। বস্তুত খ্রীস্টানরা ‘গড’ বলতে যা বুঝায়, তার সঠিক শব্দ ও অর্থের প্রকাশ একমাত্র এই ‘আল্লাহ্’ শব্দেই সম্ভব। মুসলমানেরা এই ‘আল্লাহ্’ শব্দের দ্বারা হজরত মূসা ও হজরত ঈসার (যীশু) স্রষ্টাকেই বুঝিয়ে থাকেন।
এ ছাড়াও ভাটিক্যানের ‘নন-ক্রিশ্চিয়ান এ্যাফেয়ার্স’ দফতর থেকে প্রকাশিত এই দলিলে এই মৌলিক বিষয়টির উপরে গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে : ‘‘পাশ্চাত্যের কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে, ‘আল্লাহ্’ আসলে পরম সৃষ্টিকর্তা বা গড নন!--তাদের সে ধারণা কিন্তু একেবারেই অবান্তর।’’ অত্র দফতরের এই দলিলে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সঠিক বিষয়ে সার্বিক নিশ্চয়তা সহকারে ‘‘লুসেন জেনটিয়াম’’-এ পরম স্রষ্টার উপরে মুসলমানদের বিশ্বাস-সম্পর্কিত বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : ‘‘মুসলমানেরা হজরত ইবরাহীমের ধর্মবিশ্বাসই পোষণ ও পালন করে থাকেন এবং আমাদের মত তাঁরাও সেই পরম স্রষ্টারই উপসনা বা ইবাদত করেন, যিনি পুনরুত্থান দিবসের বিচারকর্তা।. . .”
সুতরাং ইউরোপীয় ভাষায় চিরাচরিত ‘গডে’র পরিবর্তে কেউ যখন ‘আল্লাহ্’ শব্দ ব্যবহার করেন, তখন মুসলমানেরা কেন যে প্রতিবাদ জানান, তার কারণ খুবই বোধগম্য। . . . তাই এটাও বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে, ডি. ম্যাসন যখন ফরাসী ভাষায় কোরআন তরজমা করতে গিয়ে শেষপর্যন্ত ‘আল্লাহ্’ শব্দের পরিবর্তে ‘উরব’ি (ইংরেজি অর্থ--গড্) শব্দ ব্যবহার করেন, তখন মার্জিত রুচির মুসলমানেরা কেন তাঁর প্রশংসায় মুখর না হয়ে পারেন না।
উল্লেখ্য যে, ভাটিক্যান ডকুমেন্টে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে, আরবী ভাষাভাষী খ্রীস্টানদের মধ্যেও ‘গড’ শব্দের বদলে ‘আল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আসলে মুসলিম ও খ্রীস্টান উভয় জাতিই একই স্রষ্টার উপসনা করে থাকে। এভাবে ভাটিক্যান দলিলে ইসলাম সম্পর্কে খ্রীস্টান জগতে আরো যেসব ভিত্তিহীন ধারণা পোষণ করা হয়ে থাকে, সেসবেরও কড়া সমালোচনা করা হয়েছে।
‘ইসলামী অদৃষ্টবাদ’ বলে পাশ্চাত্যে খ্রীস্টান-সমাজে আরও একটি কুসংস্কারপূর্ণ ধারণা চালু রয়েছে। ভাটিক্যান ডকুমেন্টে এ বিষয়টির উপরেও বিশদ আলোচনা ও বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে এবং সে আলোচনায় পাশ্চাত্যের খ্রীস্টান-সমাজে প্রচলিত এই ধারণার সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, ‘অদৃষ্ট সম্পর্কে মুসলমানদের আকিদা বা বিশ্বাস খ্রীস্টানদের তথাকথিত ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।’ ডকুমেন্টে এই বক্তব্যের সপক্ষে কোরআনের বাণী তুলে ধরে এও বলা হয়েছে যে, ‘মুসলমানেরা মানুষের নিজস্ব দায়িত্ব মোটেও অস্বীকার করেন না; বরং বিশ্বাস করেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই বিচার হবে তার কর্মফল দ্বারা।’ এ ছাড়াও জবরদস্তিমূলক কোনো কাজের ব্যাপারে মুসলমানেরা তাদের ধর্ম থেকে বৈধতা খুঁজে নেয় বলে খ্রীস্টান-সমাজে যে ধারণা চালু রয়েছে, উক্ত ভাটিক্যান ডকুমেন্টে তারও সমালোচনা করা হয়। বলা হয়, মুসলমানেরা অবশ্যই তাঁদের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান। কিন্তু যে কোরআন সম্পর্কে পাশ্চাত্যে ব্যাপক ভ্রান্তি বিদ্যমান, সেই কোরআনেই রয়েছে এমন দু’টি বাণী-- যা ইসলামে জবরদস্তির বৈধতা-সংক্রান্ত পাশ্চাত্য ধারণার পুরোপুরি বিপরীত। যেমন :
- ‘‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।’’ ( সূরা ২, আয়াত ২৫৬ )
- ‘‘(আল্লাহ্) ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপরে কোনো কঠোরতা বা সংকীর্ণতা চাপিয়ে দেন নি।’’ ( সূরা ২২, আয়াত ৭৮)
এ ছাড়াও উক্ত ভাটিক্যান ডকুমেন্টে-‘ইসলাম ভীতির ধর্ম’-- বলে ব্যাপকভাবে চালু ধারণারও বিরোধীতা করা হয় এবং বলা হয় যে, ‘ইসলাম হল প্রেমের ধর্ম’ ;- এতে পড়শীকে ভালবাসার নির্দেশ রয়েছে এবং বলা হয়েছে, পড়শীর প্রতি এই ভালবাসা-- আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস থেকেই উৎসারিত। তদুপরি, ‘মুসলমানদের মধ্যে কোনোরকম নৈতিকতাবোধ অনুপস্থিত’,- পাশ্চাত্যে প্রচলিত এই ধারণাও উক্ত ডকুমেন্টে খণ্ডন করা হয়। বহু ইহুদী ও বহুসংখ্যক খ্রীস্টানও মনে করেন যে, ইসলাম আসলে গোঁড়ামিসর্বস্ব ধর্ম। ভাটিক্যান ডকুমেন্টে এই ধারণারও প্রতিবাদ জানানো হয়। এইসব ধারণার প্রতিবাদে ভাটিক্যান ডকুমেন্টে বলা হয়, ‘‘আসলে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পর খ্রীস্টধর্ম গোঁড়ামির যতটা পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিল, ইসলামের গোঁড়ামি তার থেকে মোটেও বেশি ছিল না।’’
এই স্থানে উক্ত ডকুমেন্টের লেখকবৃন্দ কোরআনের উদ্ধৃতি তুলে ধরে দেখিয়েছেন --পাশ্চাত্যে কিভাবে ‘পবিত্র ধর্মযুদ্ধ’ বা জেহাদ শব্দের কদর্থ করা হয়ে থাকে। আরবীতে বলা আছে- ‘আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ --এর অর্থ ‘‘আল্লাহ্র পথে প্রয়াস চালানো’’, ‘‘ইসলাম প্রচারে প্রচেষ্টা গ্রহণ’’ এবং ‘‘আক্রমণকারীর কবল থেকে ইসলামকে সংরক্ষণ’’। ভাটিক্যান ডকুমেন্টে এ সম্পর্কে আরো বলা হয়, ‘‘জেহাদ কোনোক্রমেই বাইবেলোক্ত ‘খেরেম’ নয়; এবং এই ‘জেহাদ’-এর তাৎপর্যও কাউকে নির্মূল করা বোঝায় না; বরং এর দ্বারা নতুন কোনো দেশে আল্লাহ্র ও মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজকেই বোঝানো হয়ে থাকে।’’ ‘‘অতীতে ‘জেহাদ’-এর নামে যে রক্তক্ষয় ঘটেছে, তা চিরাচরিত যুদ্ধের রীতি অনুসারেই সংঘটিত হয়েছে। ক্রুসেডের সময়ে যা কিছু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, দেখা গেছে, সেজন্য কেবল মুসলমানেরাই এককভাবে দায়ী ছিল না।’’
পরিশেষে, উক্ত ভাটিক্যান দলিলে পাশ্চাত্যজগতে প্রচলিত আরেকটা কুসংস্কার খণ্ডন করা হয়েছে। উক্ত কুসংস্কারজাত-র্পূব ধারণাটা এরকম : ‘‘ইসলাম তার অনুসারীদের ধর্মীয় বাঁধন-কষণে মানসিক দিক থেকে এমনভাবে পঙ্গু করে রাখে যে, তারা মধ্যযুগীয় ভাবধারায় আটকা পড়ে থাকতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের পক্ষে আধুনিক যুগের কারিগরি উৎকর্ষের সাথে কোনক্রমেই খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয় না।’’ উক্ত ভাটিক্যান ডকুমেন্টে খ্রীস্টান-সমাজে বিরাজমান একই ধরনের পরিস্থিতির তুলনা করে বলা হয়েছে : ‘‘আমরা দেখেছি (. . . ) মুসলিম চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের ব্যাপ্তি এতো ব্যাপক যে, তার মধ্যে নাগরিক সমাজের সম্ভাবনাপূর্ণ নীতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমাজ বির্বতনেরও বিস্তর অবকাশ।’’
আমি নিশ্চিত যে, ভাটিক্যান কর্তৃক ইসলামের সপক্ষে এ ধরনের বক্তব্য শুনে বহু বিশ্বাসীই- তাঁরা মুসলমান, ইহুদী বা খ্রীস্টান- যে হোন না কেন- বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। কেননা, এই মানসিকতা অতীতের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই ভাবধারা বরং নিষ্ঠা ও উদারতার কার্যকর বহিঃপ্রকাশ। তবে, ক্যাথলিক গির্জার সর্বোচ্চ মহলে অধুনা ইসলাম সম্পর্কে এই যে দৃষ্টিভঙ্গির অনুসৃত হচ্ছে, সে সম্পর্কে পাশ্চাত্যের খুব কমসংখ্যক মানুষই ওয়াকেফহাল।
অবশ্য একবার এই সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেলে এর পরবর্তী ঘটনাবলীতে, বিশেষত ইসলামের সাথে খ্রীস্টধমের্র বন্ধুত্ব স্থাপনের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখে কেউ আর তেমন বিস্ময়বোধ করবেন না। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী পর্যায়ের এসব পদক্ষেপের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় ভাটিক্যানের ‘নন-ক্রিশ্চিয়ান এ্যাফেয়াস’ দফতর-প্রধানের সউদী আরব সফর এবং বাদশাহ্ ফয়সালের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের কথা। দ্বিতীয়ত আসে ১৯৭৪ সালে সউদী আরবের গ্র্যান্ড উলেমা দলের ভাটিক্যান সফরে ষষ্ঠ পল কর্তৃক সরকারীভাবে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের কথা। এই সঙ্গে আরো যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, তারও ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য কম নয়। তা হল, মহামতি বিশপ এলচিঙ্গার স্বয়ং স্টার্নবুর্গের প্রধান গির্জায় গ্র্যান্ড উলেমা দলকে স্বাগত জানানো এবং নামাজের সময় হলে গির্জার মধ্যেই বিশপ তাঁদের নামাজ পড়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। গ্র্যান্ড উলেমা দলও বিনা দ্বিধায় গির্জার বেদীর সামনে মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করে নেন। এভাবে সউদী আরব ও ভাটিক্যানের সম্মতিক্রমে- একই স্রষ্টাতে বিশ্বাসী ও পরস্পরের মতপার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মুসলিম ও খ্রীস্টান- এই দুই ধর্মবিশ্বাসীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিবর্গ আলোচনা বৈঠকে বসতে রাজি হন। বলা অনাবশ্যক যে, সংলাপের এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে স্বাভাবিকভাবে এই দুই ধর্মের প্রত্যাদেশ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও কথা উঠবে। আর তা হলে, সেই আলাপ-আলোচনার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তথ্য-পরিসংখ্যানের আলোকে উভয় ধর্মের ধর্মীয়-গ্রন্থাবলীর সঠিকত্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষার কথাও না ওঠে পারবে না। ফলে, তখন কোরআনের ব্যাপারেও যেমন এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে, তেমনি সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে ইহুদী-খ্রীস্টানদের প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ধর্মগ্রন্থ তথা বাইবেল সম্পর্কেও।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক দেশে-দেশে কালে-কালে কোনো সময়ই এক রকম ছিল না। একথা অসত্য নয় যে, একত্ববাদী কোনো ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞানের বিরোধিতা কিংবা নিন্দাসূচক কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু বাস্তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোনো কোনো ধর্মের র্শীষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দ্বারা বিজ্ঞানীরা যে নিদারুণভাবে বাধাগ্রস্থ হয়েছিলেন, তা অস্বীকার করা চলে না। যদিও ক্যাথলিক-ধর্মশাস্ত্রে কোনো নির্দেশ ছিল না, তবুও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খ্রীস্টান-জগতের ধর্মগুরুগণ বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে গেছেন এবং এই বিরোধিতা তাঁরা করেছেন সম্পূর্ণভাবে নিজেদের মনগড়া ধারণার বশবতী হয়েই। আমরা জানি, কিভাবে ওইসব ধর্মগুরু তাঁদের সময়কালের বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত যাঁরা বিজ্ঞানের দিগন্ত সম্প্রসারিত করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূূলক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এমনও দেখা গেছে, ওইসব ধর্মগুরুর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে, বিশেষত ধর্মদ্রোহী হিসেবে পুড়ে মরার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে, বিজ্ঞানীদের দেশত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে। যাঁরা দেশত্যাগ করেননি, তাঁেদর হয় নিজেদের অভিমত প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে; নতুবা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন জানাতে হয়েছে। এপ্রসঙ্গে গ্যালিলিওর উদাহরণ সব সময়ই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। গ্যালিলিওর অপরাধ ছিল, তিনি কোপারনিকাস-আবিষ্কৃত পৃথিবী-ঘূর্ণনের অভিমত সমর্থন করেছিলেন। আসলে, বাইবেলের বক্তব্যের ভুল-ব্যাখ্যা করে নিয়ে গ্যালিলিওকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। বাস্তবে বাইবেলের এমন কোনো বক্তব্য নেই, যা গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে যুক্তি হিসাবে দাঁড় করানো যেতে পারে।
বিজ্ঞানের ব্যাপারে ইসলামের র্দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণত সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ বিষয়ে মোহাম্মদের (স.) বক্তব্য দিবালোকের মতই স্পষ্ট। তিনি বলে গেছেন ‘‘জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের জন্য যদি সুদূর চীন দেশে যেতে হয়, তা হলেও পিছপা হয়ো না।’’ অন্য এক হাদীসে(বক্তব্যে) তিনি বলেছেন : ‘‘জ্ঞান আহরণ প্রত্যেক মুসলমান নারী ও পুরুষের জন্য ফরজ।” এই অধ্যায়ের পরবর্তী আলোচনায় আমরা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখতে পাব যে, কোরআন শুধু বিজ্ঞানচর্চার আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, খোদ কোরআনের মধ্যেও প্রাকৃতিক বহু বিষয়ের পর্যবেক্ষণ ও তৎসংক্রান্ত বিশদ ব্যাখ্যা বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, কোরআনের ওইসব বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বক্তব্য ও বিশ্লেষণ আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের সঙ্গে পুরোপুরিভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ। কোরআনের এ ধরনের বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্যের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে, এমন কোনো বাণী কিংবা বক্তব্য ইহুদী ও খ্রীস্টানদের ধর্মগ্রন্থে অনুপস্থিত।
অবশ্য ইসলামের ইতিহাসে কস্মিনকালেও যে ধর্মীয় কোনো মহল কর্তৃক বিজ্ঞানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা হয় নি, সে ধারণাও সঠিক নয়। কোনো কোনো সময়ে জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের প্রতি যথেচ্ছ অবহেলা প্রদর্শিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, অন্যসব ধর্মের মতই ইসলামী জগতেও কোনো কোনো সময়ে বিজ্ঞানের গতি স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রয়াস চলেছে। কিন্তু সেইসঙ্গে একথাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে খ্রীস্টান-জগতে যখন বিজ্ঞানের চর্চা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, সে সময়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিজ্ঞানের ব্যাপক অনুশীলন চলছিল; এবং বিজ্ঞানের বহু অবদানও আবি®কৃত হয়েছিল সেই আমলে। আসলে, সে সময়টা ছিল ইসলামের গৌরবের স্বর্ণযুগ। এ সময়ে ইসলাম তার গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলছিল। কর্ডোভায় স্পেনীয় খলিফার যে লাইব্রেরী ছিল, সেখানে সংগৃহীত পুস্তকের সংখ্যা ছিল চার লক্ষাধিক। আভিরোস (ইবনে রুশ্দ) সেখানে তখন শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন এবং সেখানে তখন পুরোদমে চলছিল গ্রীক, ভারতীয় ও পারসিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। সে কারণে গোটা ইউরোপ থেকে শিক্ষার্থীরা দলে দলে গিয়ে জমা হয়েছিল কর্ডোভায়--ঠিক যেমন এ কালে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করে থাকে। আজ আমরা এমন বহু প্রাচীন পান্ডুলিপি পাচ্ছি --যেসব সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পুরো কৃতিত্ব হচ্ছে আরবীয় জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের। মুসলমানেরা যখনই যে দেশ দখল করেছেন-তার সং¯কৃতিকে তাঁরা রীতিমত লালন করেছেন; তারপর সংস্কৃতির সেই ধারা পৌঁছে দিয়ে গেছেন আরেক যুগের মানুষের কাছে। অঙ্কের ব্যাপারে তো বটেই (এ্যালজেবরা ছিল আরবদেরই আবিষ্কার), এছাড়াও জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান (আলোকবিজ্ঞান), ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিজ্ঞান, চিকিৎসা-বিজ্ঞান (আভিসিনা --ইবনে সিনা) প্রভৃতি বিষয়ে আমরা আরব-সংস্কৃতির নিকট বহুলভাবে ঋণী। মধ্যযুগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্যবিষয় হিসাবে বিজ্ঞান সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট লাভ করে। এই যুগে মানুষ ধর্মীয় ভাবধারায় আপ্লুত ছিল। কিন্তু ইসলামী বিশ্বের এই ধর্মীয় ভাবধারা একই সঙ্গে ধর্মে বিশ্বাসী ও বিজ্ঞানী হওয়ার ব্যাপারে কোনো মানুষের জন্যে কোনো সময়ে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। বস্তুত বিজ্ঞান সে সময়ে ধর্মের ‘জমজ-বোন’ হিসাবে পরিগণিত হত; আর সেই ধারণা মুসলিম-বিশ্বে কোনো সময়ই পরিত্যক্ত হওয়ার কেনো কারণ ঘটেনি।
পক্ষান্তরে মধ্যযুগটা ছিল খ্রীস্টান-জগতের জন্য অচলায়তনের কাল; আর একই আবর্তে ঘুরপাক খাওয়ার যুগ। বলে রাখা ভাল যে, ইহুদী ও খ্রীস্টানদের ধর্মীয় কিতাবেও বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি কোনো অনীহা ছিল না; কিন্তু সেকালে ওই দুই ধর্মের সেবক হিসাবে যাঁরা নিজেদের পরিচয় দিতেন, তাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথে সৃষ্টি করে রেখেছিলেন নানা প্রতিবন্ধকতা। এর পর এল রেনেসাঁর যুগ। সেই রেনেসাঁর যুগে বিজ্ঞানীরা স্বভাবতই ধর্মীয় কর্মকর্তাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেলেন। সেই প্রতিশোধস্পৃহার ধারা অদ্যাবধি জারি রয়েছে। ফলে আজও পাশ্চাত্য জগতে বৈজ্ঞানিক মহলে যখন কেউ সৃষ্টিকর্তার কথা বলেন, তখন তাঁকে একঘরে হয়ে পড়তে হয়। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি--এটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের উপরেও সমভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তরুণ মুসলিম শিক্ষার্থীরাও এই অশুভ প্রভাব থেকে নিস্তার পাচ্ছে না।
আজকের বেশিরভাগ তরুণ বিজ্ঞানীর চিন্তাধারা খ্যাতিমান অথচ চিন্তার দিক থেকে চরম মনোভাবাপন্ন বিজ্ঞানীর চিন্তাধারার আদলেই পরিগঠিত হয়ে চলেছে। নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত জনৈক চিকিৎসাবিজ্ঞানী বছর কয়েক আগে সর্বসাধারণের বুঝবার উপযোগী একখানা বই লিখে এখন পর্যন্ত এই মর্মে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিভিন্ন মৌলিক উপাদান যে কোনো সুযোগে হঠাৎ করে জীবন্ত কিছুর সৃষ্টি ঘটাতে পারে। তাঁর মতে, এভাবে পরিবেশগত বাহ্যিক প্রভাবে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীবন্ত প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। আর এভাবেই জটিল প্রক্রিয়ার পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছে মানুষ।
অথচ অন্যদিকের বিচারে প্রাণ তথা জীবনের উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের এই ‘হঠাৎ আশ্চর্য তত্ত্ব’ সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেও মানুষকে নিঃসন্দেহে সহায়তা করতে পারে। মানুষের জন্ম এবং জীবন ধারণের ব্যাপারে যেসব প্রক্রিয়া বিদ্যমান, সে সম্পর্কে যতই গবেষণা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে তা ক্রমশই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ধরা পড়ছে। আর কেউ যখন এ সম্পর্কে অনেক বেশি খুঁটিনাটি জেনে নিতে পারছেন, তখন তাঁর পক্ষে আরো অনেক বেশি অবাক হওয়া ছাড়া উপায়ই থাকছে না। বস্তুত জীবনের যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, সে সম্পর্কে যতই জ্ঞান আহরণ করা যায়, --প্রাণের উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে উপরোক্ত ‘হঠাৎ আকস্মিক তত্ত্বে’র সম্ভাবনা ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ে। এভাবে জীবন-সংক্রান্ত জ্ঞান-গবেষণার পথে আরো বেশি অগ্রসর হলে, বিশেষত ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সকল যুক্তি একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
কিন্তু সুকঠিন এই বাস্তবতার মুখোমুখী হয়েও অনেকে নিজেদের ধ্যান-ধারণাকে তুচ্ছ বা নগণ্য ভাবতে পারছেন না। বরং বিনয়ের পরিবর্তে তাঁদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ঔদ্ধত্য ও অহংবোধ। এই অবস্থায় মানুষ যেমন তার আনন্দ ও ভোগের পথে চলতে গিয়ে সকল রকম প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করতে চায়; ঠিক তেমনিভাবেই অনেকে আজ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব। এটাই বস্তুত আধুনিক-বস্তুবাদী সমাজের মানসিক প্রতিচ্ছবি এবং আজকের পাশ্চাত্য জগতে (এবং বস্তুবাদী সমাজে) বস্তুবাদী এই ভাবধারা বিস্তার লাভ করছে অধিকমাত্রায়।
[লেখাটি ফরাসী বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলী লিখিত ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত। গ্রন্থটি বাংলায় প্রকাশ অনুবাদ ও বিক্রয়ের একমাত্র সত্ত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স রংপুর পাবলিকেশন্স লিঃ গোলারটেক, মিরপুর, ঢাকা ১৮, বাংলাদেশ’- এর পক্ষ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে লেখাটি বর্তমান পুস্তিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গ্রন্থটির অনুবাদক জনাব আখ্তার-উ্ল-আলম বিগত ২৪ জুন ২০১০ পরকালের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমান পুস্তিকাটি তাঁর পরকালীন সফলতার উসীলা হোক, আল্লাহর কাছে এ কামনা।]
[কলকাতার কট্টর নাস্তিক লেখক প্রবীর ঘোষের ‘‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’’ বইটির উত্তরে এই বইটি লেখা। পুরো বই পড়ুন অনলাইনেই।
১ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post.html
২য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_27.html
৩য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_55.html
৪র্থ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_83.html
৫ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_32.html
৬ষ্ঠ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_31.html
শেষ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_42.html]
0 Comments