আল্লাহকে বিশ্বাস করি কেন? (শেষ পর্ব)


তিন. আইনের ইসলামিকরণ

বিচারপতি আল্লামা তক্বী উসমানী

[অনুবাদঃ মাওলানা আব্দুল কাদির আল্ হাসান]

[বিচারপতি আল্লামা তক্বী উসমানী বর্তমান বিশ্বের অদ্বিতীয় ইসলামী চিন্তানায়ক। ইসলামাবাদ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির শরীয়া একাডেমী কর্তৃক প্রতি বছর এডভোকেট ও সেশন আদালতের জজগণের জন্য একটি ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এই প্রশিক্ষণ কোর্সে বিচারপতি আল্লামা ত্বকী উসমানী (দা. বা.) প্রতি বছরই বক্তব্য রাখেন। ’৯১ সালের ২৫শে আগস্ট অনুষ্ঠিত সেই প্রশিক্ষণ কোর্সে প্রচলিত আইনকে ইসলামিকরণ সম্পর্কিত তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যটিরই অনুবাদ নিম্নে পেশ করা হল।---অনুবাদক।]

   মুহতারাম সুধীমণ্ডলী! এই একাডেমির এই প্রশিক্ষণ কোর্সে  এবারই আমি প্রথম আসিনি; এর আগেও আরও এসেছি, বক্তব্য রাখার সুযোগ লাভ করেছি। আজকে আমি আপনাদের সামনে “Islamization of Laws বা আইনের ইসলামিকরণ” বিষয়ের উপর আলোচনা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আলোচ্য বিষয়টির সীমানা সন্দেহাতীতভাবে অত্যন্ত বিস্তৃত। অথচ আমার জন্য যে সময় বরাদ্দ করা হয়েছে, তা খুবই কম। তাছাড়া এখন আমার অন্যত্র আরও একটি প্রোগ্রামে যেতে হবে। তাই আজ আলোচ্য বিষয়ের প্রতি সংক্ষেপে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়াস

আমাদের জীবনের সবদিক, বিশেষ করে আইন-আদালত ও রাজনীতিকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হলে, এর যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় যে, কেন এই আয়োজন? কেন এই উদ্যোগ? এই নতুন উদ্যোগের কি-ইবা প্রয়োজন? কেন এসব প্রশ্ন করা হয়- তা যদি আমরা তলিয়ে দেখি, তাহলে এর পেছনে সক্রিয় কারণ যা পাব, তা হলো এই যে, বর্তমানে আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের জীবন পরিচালনা করছি- যেখানে কথিত বস্তাপঁচা ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণা তার আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সবখানেই একটি কথা অবিসংবাদিত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে যে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হলো ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা। ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেই সফলতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যেতে পারে। এমনি এক ‘ভ্রান্ত-ধারণা নিয়ন্ত্রিত’ সমাজে, যেখানে পৃথিবীর ছোট-বড় অনেক রাষ্ট্রই ধর্মনিরপেক্ষ হবার শুধু দাবীই  করে না, বরং ধর্মনিরেপেক্ষ হতে পেরে গর্ববোধ করে; সেখানে আইন-আদালত, ধর্ম-রাজনীতি তথা জীবনের সকল বিষয়কে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানোর স্লোগান তুললে সেই স্লোগান নতুন ও অপরিচিত মনে হওয়া স্বাভাবিক এবং এই স্লোগানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা এলে তা-ও আশ্চর্যের তেমন কিছু নয়।

পড়তে পারেন একটি বিশেষ নিবন্ধ: ভাইরাস এবং রোগজীবাণুর ধারণা বিজ্ঞান-সৃষ্ট ভুত!

   চির সুন্দর ও চির কল্যাণময় ইসলামভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসীদের প্রতিহত করতে আজ ইসলাম বিরোধী তাগুতী শক্তিগুলো ইসলামভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠার তৎপরতাকে Fundamentalism বা মৌলবাদ বলে গালি দিচ্ছে। এই মৌলবাদ শব্দটি তারা গালি হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেও মূলতঃ ধাতুগত বিচারে শব্দটি খারাপ বা মন্দ অর্থবোধক নয়। এই ফান্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদ শব্দের প্রকৃত অর্থ হল-মৌলিক নীতিমালা অনুযায়ী নিজকে পরিচালনা করা।

    বস্তুতঃ ইসলামী শিক্ষা ও জীবনব্যবস্থা নতুন কোনো কিছু নয়, বরং এটা হাজার হাজার বছর পূর্বের পুরনো। এরপরও কেন আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজাতে চাই? আজকের এই আলোচনায় আমি শুধুমাত্র এই প্রশ্নটির জবাবদানের চেষ্টা করব- ইনশাআল্লাহ্।

ধর্মনিরপেক্ষতার ঠুনকো পূঁজি

আপনাদেরকে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তা হলো- একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে তথা ধর্মহীন রাষ্ট্রে তার নায়কেরা তাদের বিচারব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থা কিসের ভিত্তিতে পরিচালিত করবে-এ সম্পর্কিত কোনো মূলনীতি তাদের থলেতে নেই। তাই ওরা বলে বেড়ায় যে, আমাদের কাছে বুদ্ধি, ভূয়ো দর্শন আর অভিজ্ঞতা রয়েছে। এসবের আলোকে চিন্তা-গবেষণা করেই আমরা নির্ধারণ করতে পারি যে, আমাদের সমকালীন যুগের প্রয়োজনটা কী? কী-ইবা এর চাহিদা? তারপর এসব চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে চিন্তা করে দেখি, কোন্ বিষয়টি আমাদের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর হবে এবং হবে আমাদের স্বার্থের অনুকূলে। এরপর এসব বিষয়ের প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের বিচারব্যবস্থা জীবনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারি।  এই পদ্ধতি ও নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে খুব সহজেই পরিবর্তন আনতে পারি আমাদের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থায়।

   ধর্মনিরপেক্ষ সাইনবোর্ডধারী ধর্মহীন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় বুদ্ধি, ভূয়ো দর্শন আর অভিজ্ঞতাই সত্যাসত্য ও ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের চূড়ান্ত মাপকাঠি হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে যে, তাদের এই মাপকাঠি কতটুকু নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। তাদের এই মাপকাঠি কি কিয়ামত পর্যন্ত আগত প্রজন্মকেও সঠিক পথের দিশা দিতে পারবে? শুধুমাত্র এই বুদ্ধি, ভূয়ো দর্শন আর অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করাই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে?

   উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হলে আমাদেরকে দেখতে হবে যে, কোনো ব্যবস্থাপনায় যখন তার অতীত-জ্ঞানের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে পড়ে, তখন আর তা সফলতার সাথে চলতে পারে না। যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষকে কতগুলো মাধ্যম দান করেছেন। এই মাধ্যমগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যেই তাদের নিজস্ব কর্মপরিসর রয়েছে। জ্ঞানের প্রতিটি মাধ্যমই তার নিজস্ব কর্মপরিসরে ক্রিয়াক্ষম আর তার কর্মপরিসরের বাইরে সে নিষ্ক্রিয়।

পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের কর্মপরিসর

পূর্বে আলোচিত বিষয়টি আশা করি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে একটি উদাহরণ পেশ করলে। তা হলো আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সর্বপ্রথম জ্ঞানার্জনের যে মাধ্যমসমূহ দান করেছেন সেগুলো হল পঞ্চ-ইন্দ্রীয় তথা- চোখ, নাক, কান, জিহ্বা ও ত্বক।

   জিহ্বার দ্বারা স্বাদ সম্পর্কে জানা যায়। কান দ্বারা শুনা, চোখ দ্বারা দেখা, ত্বক দ্বারা স্পর্শ এবং নাক দ্বারা ঘ্রাণ নেয়ার মাধ্যমে অনেক অনেক বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা যায়। আমাদের দর্শনক্ষমতার ভিতরের এই পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব কর্মপরিসর রয়েছে। নিজ নিজ কর্মপরিসরের বাইরে এরা কেউই কোনো প্রকার কাজ করতে পারে না। যেমন ধরুন চোখ দ্বারা দেখা যায়। কিন্তু শ্রবণ করা যায় না। কান দ্বারা শ্রবণ করা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। এমনকি দেখার কল্পনাও করা যায় না। এরপরও কোনো মানুষ যদি কান দ্বারা দেখার চেষ্টা করে, আর তার প্রচেষ্টা সম্পর্কে যদি মানুষ জানে, তাহলে সন্দেহ নেই যে, যে-ই জানবে সে-ই তাকে চরম বোকা ভাববে। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে যে, তোমার কান কোনো কিছুই দেখতে পায় না, এই কানের কোনো দরকার নেই, ফেলে দাও এই কান, তাহলে এই ব্যক্তিকেও মানুষ বোকা যে বলবে তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

   এক্ষেত্রে কারণ একটাই, তাহলো- সে জানে না যে, কানের একটি নিজস্ব কর্মপরিসর রয়েছে। সে তার এই কর্মপরিসরের ভেতরেই শুধুমাত্র কাজ করতে সক্ষম, এর বাইরে নয়। সুতরাং কান দ্বারা যদি দেখার চেষ্টা করে তাহলে তা কিছুতেই কাজ করতে সক্ষম হবে না। কান দ্বারা শুধু শুনার কাজই নেয়া যাবে।

বুদ্ধির কর্মক্ষমতা

পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতিভাত হল যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষকে জ্ঞানলাভের জন্য পাঁচটি ইন্দ্রীয় শক্তি দান করেছেন। এই পাঁচটি ইন্দ্রীয়ের সাথে সাথে জ্ঞানের জন্য দান করেছেন ‘বুদ্ধি’ নামের আরেকটি মাধ্যম। জ্ঞানার্জনের পথ-পরিক্রমায় এমন একটি স্তর আছে যেখানে পঞ্চ-ইন্দ্রীয় তাদের কর্মক্ষমতার হাত বাড়াতে সক্ষম হয় না। এই স্তরে গিয়ে চোখ, কান, জিহ্বা ও ত্বক নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই হলো সেই স্তর, যেখানে বস্তু ইন্দ্রীয় শক্তির পরাভব-মুক্ত। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে দান করেছেন বুদ্ধি নামক আরেকটি জ্ঞান-মাধ্যম।

   পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের কর্মক্ষমতা যেখানে শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকেই শুরু হয় বুদ্ধির কাজ। মনে করুন, আমার সামনে রাখা আছে একটি টেবিল, এই টেবিলটি চোখে দেখে আমি বলতে পারব এর রং কিরূপ। হাতে ছোঁয়ার পর আমি বলতে পারি এটা শক্ত কাঠের তৈরি এবং এর উপর লাগানো হয়েছে ফরমিকা। যদি প্রশ্ন করা হয়, এ টেবিল কোত্থেকে এল, তাহলে এ প্রশ্নের জবাব পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব নয়। আমার চোখ এটা দেখছে না, কান শুনছে না, আর স্পর্শের মাধ্যমেও এ জ্ঞান লাভ সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এটা আমার সামনে তৈরি হয়নি। এহেন প্রেক্ষাপটে আমার বুদ্ধি আমাকে পথপ্রদর্শন করছে যে, এই যে এত মসৃণ ঝকঝকে টেবিল, এটা এমনিতেই অস্তিত্বের জগতে আসেনি। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো এক সুনিপুণ দক্ষ মিস্ত্রী এটা তৈরি করেছে। এই টেবিল নির্মাতা সম্পর্কে আমার বুদ্ধিই আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছে। সুতরাং যা বলছিলাম তাহলো, যেখানে পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়, সেখান থেকেই মানুষের বুদ্ধির কাজ আরম্ভ হয়।

বুদ্ধির সীমানা

পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের কাজের সীমানা যেমন অসীম নয়, তেমনি বুদ্ধির কর্মপরিসরও অসীম নয়। একটি স্তরে গিয়ে এর কর্মপরিসরও শেষ হয়ে যায়। একটি সুনির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বুদ্ধি ক্রিয়াশীল। তারপর আর সে সক্রিয় থাকতে পারে না। হয়ে পড়ে নিষ্ক্রিয়। সুতরাং বুদ্ধির কর্মসীমানার বাইরে একে ব্যবহার করতে চাইলে এটা তখন যথার্থ উত্তর দেবে না। দেবে না সঠিক পথের দিশা। শেখ সা’দী রহ. বলেন,

         ‘সব জায়গাতে বুদ্ধির ঘোড়া

         দৌড়তে নাহি পারে,

         ক্ষেত্রবিশেষে বাহন চড়ে

         স্বীয় যাত্রীর ঘাড়ে।”

ওহী-প্রসঙ্গ

পঞ্চ-ইন্দ্রীয়ের ক্ষমতা শেষ হয় যেখানে, সেখান থেকে শুরু হয় বুদ্ধির কার্যক্রম। বুদ্ধিও নির্দিষ্ট সীমা পেরিয়ে যখন আর কাজ করতে পারে না, তখন মানুষকে জ্ঞানার্জনের জন্য আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তৃতীয় আরেকটি মাধ্যম দান করেছেন, যার নাম ‘ওহী’। ওহী হলো আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নবী-রাসূলগণের (আল্লাহ্-মনোনীত মানুষ) মাধ্যমে প্রেরিত প্রত্যাদেশ, বাণী ও শিক্ষা। বুদ্ধির ঘোড়া যেখানে গিয়ে তার দৌড় শেষ করে, সেখান থেকেই শুরু হয় ওহীর কার্যক্রম। চোখের কাজের জন্য নাক ব্যবহার করা, কিংবা ঘ্রাণ নেবার জন্য কান ব্যবহার করা, চোখ ব্যবহার করা যেমন বোকামী, তেমনি যেক্ষেত্রে ওহীর প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে বুদ্ধির ব্যবহারও নিতান্ত বোকামী।

   লক্ষ্য রাখবেন, আমার আলোচনা দ্বারা আমি বুদ্ধিকে অকেজো প্রমাণ করতে চাচ্ছি না, বরং বুঝাতে চাচ্ছি যে, বুদ্ধি তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল। সে তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্রের বাইরে কাজ করতে অক্ষম ও অচল। অথচ এই গন্ডিবদ্ধ বুদ্ধিই পূঁজিবাদের ভিত্তি। কতই না ঠুনকো তার বুুনিয়াদ!

সেক্যুলারিজম ও ইসলাম

ইসলামী জীবনব্যবস্থা ও সেক্যুলার জীবনব্যবস্থা এক নয়। এই দু’য়ের মাঝে অনেক অনেক ব্যবধান রয়েছে। সেক্যুলারিজমের অনুসারীরা জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনের শুধুমাত্র প্রথম দু’টি স্তরকেই ব্যবহার করে থাকে, এরপর থেমে যায়। আর অগ্রসর হতে পারে না। সামনে অগ্রসর না হতে পেরে তারা বরং বলে ফেলে যে, জ্ঞান লাভের আর কোনো মাধ্যম নেই। আমাদের চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক এবং বুদ্ধিই শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের মাধ্যম এবং এগুলোই যথেষ্ট। কিন্তু এক্ষেত্রে ইসলাম বলে, পঞ্চ-ইন্দ্রীয় আর বুদ্ধিই শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়, এ মাধ্যমসমূহ ছাড়াও জ্ঞানার্জনের আরও একটি শক্তিশালী মাধ্যম রয়েছে, যার নাম ওহী।

ওহীর অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা

সেক্যুলারপন্থীদের ভ্রান্তবিশ্বাস অর্থাৎ পঞ্চ-ইন্দ্রীয় এবং বুদ্ধিই সকল প্রকার জ্ঞানার্জনের মাধ্যম-এ ধারণা খণ্ডন করে চিরকল্যাণময় ইসলামের বলিষ্ঠ ঘোষণা হলো-- পঞ্চ-ইন্দ্রীয় আর বুদ্ধিই কেবল সর্বপ্রকার জ্ঞান অর্জন করতে পারে না, বরং অনেক অনেক ক্ষেত্রে ওহীর তীব্র প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামের এই ঘোষণা বা দাবী বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, তা-ই এখন বুঝা প্রয়োজন।

বুদ্ধি ও ওহীর ক্ষেত্রব্যবধান

ইদানিং বুদ্ধিপূঁজার বড় তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায়। বলা হয়, সবকিছুই নাকি বুদ্ধির মাপকাঠিতে পরিমাপ করে অবলম্বন করা যায়। অথচ একথা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। কারণ এটা চিরসত্য যে, বুদ্ধির কাছে এমন কোনো সর্বজনীন ধরাবাঁধা নিয়মনীতি নেই, যা দুনিয়ার সকল মানুষ মেনে নেবে; যা দ্বারা সে বৈধ-অবৈধ ও ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে পারবে। ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের দায়িত্ব যদি আমরা বুদ্ধির উপর ছেড়ে দিই, তাহলে তার পরিণাম কী হবে তা উপলব্ধি করতে আমাদের কষ্ট করে একটু পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আমরা দেখতে পাব, এই বুদ্ধি অবাধে গণ্ডিহীনভাবে চলার কারণে আমাদেরকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, বিশৃঙ্খলায় ফেলেছে এবং নিক্ষেপ করেছে প্রতারণার ইন্দ্রজালে। বুদ্ধিকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দিলে তা যে কত স্বেচ্ছাচারী ও ধংসাত্মক হতে পারে, তা বুঝার জন্য ইতিহাসের পাতা থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।

১. ভাই-বোনের বিয়ে বুদ্ধিবিরোধী নয়

দীর্ঘ প্রায় আটশত বছর পূর্বে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বাতেনী সম্প্রদায় নামে একটি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়েছিল। এই সম্প্রদায়েরই অন্যতম নেতা ছিলেন উবাইদুল্লাহ বিন হাসান কাইরাওয়ানী। তিনি তার অনুসারীদের প্রতি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন, যাতে তিনি তার অনুসারীদের জীবনযাত্রার নীতিমালা ও নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “মানুষ তার নিজের ঘরেই পরমা সুন্দরী বোন থাকতেও কেন যে তাকে বাইরের একজন অচেনা লোকের হাতে তুলে দিয়ে নিজের জন্য বেছে আনে অন্য স্থান থেকে আরেকজন অপরিচিতা মেয়েকে, যে তার মন-মানসিকতা ও স্বভাব-মেজাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না---বিষয়টা আমার বুঝে আসে না। এ কাজটি আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে। শুধু তা-ই নয়, এ কাজটি আমার কাছে বোকামীও মনে হয়। কারণ অনেক সময় দেখা যায় যে, নিজের জন্য ঘরে যে নববধূ তুলে এনেছে, সে তার নিজ বোনের চেয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি, রূপ-সৌন্দর্যের দিক দিয়ে নিজের জন্য তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। নিজের সম্পদ পরকে দিয়ে পরের সম্পদ নির্বাচন করার পেছনে কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি আমার অনুসারীদেরকে এ জাতীয় বোকামী করা থেকে বেঁচে থাকার জন্য অনুরোধ করছি। বলছি, ঘরের ধন যেন তারা নিজের ঘরেই রাখে।”

[আল্-র্ফাক বাইনাল ফিরাক্ব, পৃষ্ঠা : ২৯৭/বায়ানু মাযাহিরিল বাতিনিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৮০]

২. বোন দ্বারা যৌন-প্রশান্তি বুদ্ধিবিরোধী নয়

অন্যত্র ওই উবাইদুল্লাহ বিন হাসান কাইরাওয়ানী নিছক বুদ্ধির উপর ভিত্তি করে তার অনুসারীদেকে লিখে জানিয়েছে, “বোন তার ভাইয়ের জন্য খানা রান্না করতে পারে, ক্ষুধা দূর করতে পারে, তার আরাম-আয়েশের জন্য কষ্ট করতে পারে, তার পোশাকআশাক সাজিয়ে রাখতে পারে, তার বিছানাপত্র ঠিকঠাক করতে পারে, এতকিছু করতে পারার পরও তার ভাইয়ের যৌন-প্রশান্তির সামগ্রী কেন হতে পারে না, তা আমার কিছুতেই বুঝে আসে না। এটা আমার কাছে চরম বোকামী ও বুদ্ধিবিরোধী কাজ বলেই মনে হয়।”

   উবাইদুল্লাহ বিন হাসান কাইরাওয়ানীর উপরে বর্ণিত ঘৃণ্য বুদ্ধিভিত্তিক মতবাদের প্রতি হাজারো অভিশাপ বর্ষণ করলেও অনুরূপ এমন কোনো বুদ্ধিভিত্তিক মতবাদ দিয়ে তার মতবাদ কিয়ামত পর্যন্ত খণ্ডন করা সম্ভব নয়--যা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক প্রেরিত ওহীর প্রভাবমুক্ত। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, শুধুমাত্র বুদ্ধি দ্বারা এর সমাধান করা সম্ভব নয়।

   আমরা কেউ কেউ হয়তো একথা বলে ফেলতে পারি যে, এটাতো জঘন্য কুকর্ম ও মারাত্মক ধরণের অশ্লীল কাজ। হ্যাঁ, যদি আমরা কেউ একথা বলেই ফেলি, তাহলে নিছক বুদ্ধির উপর ভর করে জবাবে বলা যায় না যে, এটা আদৌ কোনো কুকর্ম নয়, অশ্লীল কাজ নয়। কারণ আমরা যে বুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করছি, সেই বুদ্ধির কাছে ন্যায়-অন্যায় ও বৈধ-অবৈধ পৃথকীকরণের সর্বজনীন কোনো নীতিমালা নেই। বরং এই শব্দগুলো পুরোপুরিই আপেক্ষিক এবং সমাজ ও পরিবেশের সৃষ্টি করা কিছু ধারণার শাব্দিক রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি যেহেতু এমন একটি সমাজে বেড়ে উঠেছেন--যেখানে এই কাজটিকে ঘৃণার চেখে দেখা হয়, এ কারণেই আপনি আপনার সামাজিক রুচিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে এ কাজটিকে মন্দ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু কেউ যদি এমন সমাজে জন্মগ্রহণ করে, যে সমাজে ওটাকে খারাপ নজরে দেখা হয় না, তাহলে সে ওটাকে মন্দ আখ্যায়িত করবেনা। এতে বুঝা যাচ্ছে বুদ্ধির দিকনির্দেশনা পারিপার্শ্বিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়।

   প্লেটো তার একটি গ্রন্থে লিখেছেন-

    What you think true is true for you and what you think wrong is wrong for you.

    “বুদ্ধির কাছে সত্যাসত্যের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি নেই। তোমার কাছে যা সত্য মনে হবে, তা-ই সত্য; আর যা তোমার কাছে মিথ্যা মনে হবে, তা-ই তোমার জন্য মিথ্যা বলে গণ্য হবে।”

বংশ সংরক্ষণ বুদ্ধি আবশ্যক ভাবে না

বংশ সংরক্ষণের বিষয়ে দু’টি পন্থা আছে। ১. বৈধ, ২. অবৈধ। বংশ সংরক্ষণের অবৈধ পন্থা সম্পর্কে যদি আপনার বুদ্ধি বলে যে, এতে মানুষের বংশ-পরম্পরা নষ্ট হয়ে পড়বে, তাহলে জবাবে বলা হতে পারে যে, তা হতে দাও। এতে অমঙ্গল আর অকল্যাণের কী আছে। বংশের সংরক্ষণ কি এমনই কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়মনীতি যে, তা অনুসরণ করা খুবই জরুরী তাতো নয়!

    আপনি যদি প্রতুত্তরে বুদ্ধির জোরে বলেন যে, এতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর দিক রয়েছে। কারণ প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতানুযায়ী, রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনের সাথে সহবাস করা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এতে উৎপাদিত সন্তান দুর্বল হয়ে থাকে। সুতরাং এ থেকে বেঁচে থাকা উচিৎ। তখন বলা হতে পারে যে, উপরে বর্ণিত এ মতটি হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর মতবাদ। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে পাশ্চাত্য জগতে বিষয়টি নিয়ে প্রচুর বিশ্লেষণ আর গবেষণা চলছে। এই তো কিছুদিন আগে তারা বলে দিয়েছে যে, রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনের সাথে যৌনক্ষুধা নিবারণ মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও সাম্প্রতিক কালের মেডিক্যাল গবেষণা থেকে আরও জানা যায় যে, এর যে স্বাস্থ্যগত ক্ষতিসমূহের কথা পূর্ব থেকে প্রচলিত আছে, তা সঠিক নয়।

   সাম্প্রতিক কালের মেডিক্যাল গবেষণার এই তথ্যটি যেন আজ হতে আটশত বছর পূর্বের সেই উবাইদুল্লাহ বিন হাসান কাইরাওয়ানীর মতবাদেরই আধুনিক সংস্করণ। তবে আশ্চর্যের হলেও একথা সত্য যে, বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজে ইতিমধ্যেই এই প্রথা চালু হতে দেখা গেছে। এসবই হয়েছে বুদ্ধির জোরে। কারণ বুদ্ধির নিকট এ ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি নেই।

ওহীর কর্মক্ষেত্রে বুদ্ধির ডিগবাজি

এই যে বুদ্ধির ফলাফল বিপর্যয় ও বিপথগামীতা, তা কেন হচ্ছে? যদি বিষয়টি নিয়ে আমরা হালকাভাবেও চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে সক্ষম হবো যে, আমরা আমাদের বুদ্ধিকে তার নির্দিষ্ট কর্মসীমানার বাইরে ব্যবহার করছি বলেই তা হচ্ছে, অন্য কারণে নয়। যেখানে মূলতঃ ওহী বা আল্লাহ্-প্রদত্ত হুকুম-আহকামের প্রয়োজন, সেখানে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র, সীমিত ও ওহীর প্রভাবমুক্ত বুদ্ধি দ্বারা কাজ সমাধা করতে অপচেষ্টা চালিয়েছি। তাই নির্দ্বিধায় আজ একথা বলা যায় যে, বুদ্ধিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক প্রেরিত ওহীর প্রভাবমুক্ত করার ফলেই আমেরিকা ও বৃটেনের লোকেরা হযরত ঈসা (আ.) -এর উপর নাযিলকৃত আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের বিশেষ চারটি আসমানী কিতাবের অন্যতম একটি ‘ইঞ্জিলে’ বিশ্বাসী হয়েও তাদের আইনসভায় সমকামীতার মতো মানবিকতাপরিপন্থী, রুচিবিরোধী ও চরম ঘৃণ্য একটি কাজকে বৈধতার মোড়ক পরিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে।

   ইদানিং তো সমকামীতা একটি পুরাদস্তুর শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আমি এক সফরে নিউইয়র্কের একটি লাইব্রেরীতে এ বিষয়ের উপর রচিত বইয়ের আলাদা একটি সেকশন দেখতে পেয়েছিলাম। ঐ সেকশনের শিরোনাম ছিল- Gay style of live. শুধু তা-ই নয়, বরং সমকামীদের নিয়ে রীতিমত বিভিন্ন দল এবং সমিতিও রয়েছে। এদের অনেকে আবার সরকারের অনেক উচ্চ পর্যায়ের পদসমূহ অলঙ্কৃত করে আছেন।

    এছাড়াও আমেরিকার তৎকালীন টাইম ম্যাগাজিন উল্টালেই দেখতে পাবেন যে, উপসাগরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের থেকে প্রায় একহাজার সৈন্যকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে শুধুমাত্র এই দোষে যে, তারা সমকামী। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সেদেশে খুব হৈ চৈ শুরু হয়েছিল। চতুর্দিক থেকেই প্রতিবাদ এসেছিল যে, শুধুমাত্র সমকামীতার দায়ে ওদেরকে চাকুরীচ্যুত করাটা এমন একটি বিবেক ও বুদ্ধিবিরোধী কাজ, যা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তাদেরকে অনতিবিলম্বে চাকুরীতে পুণর্বহাল করা উচিত। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছেন যে, এই সমকামীতাতো মানবজীবনেরই একটি সামাজিক কর্ম। এটা দোষের কিছু নয়- যার জন্য তাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা যেতে পারে।

    দেখুন কী বর্বরতা! একুশ শতকের এই আধুনিক বিশ্বে মানুষের স্বভাবধর্মের দোহাই দিয়ে এভাবেই যারপরনাই অশ্লীল অনেক কর্মকে আধুনিকতার খোলসে বৈধতার সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। আর এসব কিছুই হয়েছে ওহীর প্রভাবমুক্ত নিরংকুশ বুদ্ধি ও বিবেকের উপর ভিত্তি করে। কেননা, বুদ্ধির বিচারে এসব খারাপ কোনো কিছু নয় । শুধু কি এতটুকু? না, বরং উপরে তো বলা হলো শুধুমাত্র মানবজাতির কথা, আরও একধাপ নয়, বরং কয়েক ধাপ নিচে নেমে নগ্ন আধুনিকতার সাইনবোর্ডধারীরা গাভী, গাধা, ঘোড়া এমনকি কুকুরের সাথে পর্যন্ত যৌন ক্ষুধা মেটাচ্ছে। আর তা করে তাতে তারা শুধুমাত্র তৃপ্তিই লাভ করে না, রীতিমত গর্ববোধও করে থাকে। (আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন!)

    আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি, বুদ্ধি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা তাহলে আরও সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে। আজকের আধুনিক বিশ্ব যে আণবিক বোমার ভয়ে শংকিত এবং আণবিক অস্ত্র হ্রাস করার পদ্ধতি অšে¦ষণে দিশেহারা, সেই আণবিক বোমা সম্পর্কে ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটেনিকা’র লেখক ও সম্পাদনা পরিষদের লিখিত বক্তব্য পাঠ করলে যে কোনো নিরীহ মানুষের গা শিউরে উঠার কথা। ঐ গ্রন্থে আণবিক বোমার বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, “হিরোশিমা ও নাগাসাকি নামক এ দু’জায়গাতেই শুধুমাত্র এ বোমার ব্যবহার হয়েছিল।” প্রবন্ধটির শেষের দিকে বোমাটির অবর্ণনীয় ধ্বংসলীলা ও ক্ষয়ক্ষতির কথা আলোচনা করা হয়েছে । কিন্তু প্রবন্ধের শুরুর দিকে বলা হয়েছে যে, “হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমা দু’টি প্রায় এক কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে তাদের জীবন।” তাদের এই বক্তব্যের পেছনে যুক্তি হল এই যে, বোমা দু’টি নিক্ষেপ করা না হলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হত এবং এতে প্রায় এককোটি মানুষের প্রাণহানি হত! লক্ষ্য করুন, ঐ গ্রন্থে আণবিক বোমার পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে এইভাবে যে, সে এককোটি মানুষের প্রাণরক্ষাকারী। এই পরিচয় যার ভিত্তিতে তুলে ধরেছে, সেটা হল বুদ্ধি। এখানে বুদ্ধি এমন এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে বৈধতা দানের পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি করেছে- যার উপর বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষ অভিশাপ বর্ষণ করে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির নবপ্রজন্ম শিশুরা পর্যন্ত যে দুর্ঘটনার কারণে পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছে, সেরকম একটি বেদনাদায়ক দুর্ঘটনাকে বৈধতাদানের যুক্তিও বুদ্ধির থলেতে খুঁজে পাওয়া যায়। এমনিভাবে যে কোনো দুর্ঘটনা ও মন্দকর্মই সংঘটিত হোক না কেন, ওহীর প্রভাবমুক্ত নিরংকুশ বুদ্ধি সবখানেই তার বৈধতার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম।

এই অপরিণামদর্শী বুদ্ধি দিয়েই গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন চলছে। আর এ অসার বুদ্ধিই সেই মতবাদসমূহের ধারকদেরকে পদে পদে বিভ্রান্তিতে ফেলে ভ্রান্ত পথে অগ্রসর করছে। যদ্দরুন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশ, সমাজ ও জাতি। তারা শাসন নামের নির্যাতনী যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ফুঁসে উঠছে। অভিশাপ দিচ্ছে, আন্দোলনে নামছে।

   একারণেই ফ্যাসিবাদীরা গোটা বিশ্বেই আজ অভিশপ্ত। রাজনীতির জগতে হিটলার আর মুসোলিনীর নাম দু’টো দু’টি গালীতে পরিণত হয়েছে। এতোকিছুর পরেও ফ্যাসিবাদের উপর লেখা তাদের বইগুলো পড়লে দেখা যায, খুবই সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী দার্শনিক নিয়মে তারা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। একজন সাধারণ পাঠক তা পাঠ করলে একথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে যে, নিঃসন্দেহে এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্য।

   আগেই বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টমানের এমন কোনো কাজ নেই, যার বৈধতার সপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এখন যদি কোনো বিবেকবান মানুষ জিজ্ঞেস করে যে, বুদ্ধির এ ধরনের গন্তব্যচ্যুতি কেন হচ্ছে? এর জবাব একটাই যে, বুদ্ধির নির্দিষ্ট গণ্ডি ও সীমারেখা আছে। সেই গণ্ডি ও সীমারেখা থেকে তাকে বের করে তারা এর অপব্যবহার করছে। বুদ্ধির সীমার বাইরের এই কর্মক্ষেত্রটি মূলতঃ ওহীর কর্মক্ষেত্র। এখানে বুুদ্ধির কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণ অচল। তাই তার গন্তব্যচ্যুতি হচ্ছে। এ কর্মক্ষেত্রের সঠিক ফলাফলের জন্য একমাত্র ওহী তথা মহাণ আল্লাহ্-প্রদত্ত নীতি-বিধানের মাধ্যমেই এর সফল কার্যসিদ্ধি সম্ভব।

ওহীর গণ্ডিতে বুদ্ধি অচল

বিখ্যাত দার্শনিক ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খাল্দুন তাঁর বিখ্যাত মুকাদ্দিমায় লিখেছেন, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে একটি অমূল্য নিয়ামত দান করেছেন, তা হলো বুদ্ধি। এই বুদ্ধির একটি নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র আছে, এই কর্মক্ষেত্রের ভেতরে যখন তাকে ব্যবহার করা হবে, শুধুমাত্র তখনই সে কাজ করবে। এর ব্যতিক্রম সে কাজ করবে না, কাজ করতে সক্ষম হবে না।

   উপমা হিসেবে তিনি বলেন, বুদ্ধি হলো মূলতঃ স্বর্ণশিল্পীর তুলাদণ্ডের মতো, যার কাঁটা কয়েকগ্রাম অমূল্য ধাতুর ওজন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। যদি কেউ এর দ্বারা দশ-বিশ কেজির কোনো জিনিস পরিমাপ করতে চায়, তাহলে তা ভেঙ্গে যাবে। এ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে যদি কেউ তুলাদণ্ডের বদনাম করে, দোষচর্চা করে বেড়ায়, তাহলে নিঃসন্দেহে যে-ই শুনবে তার সমালোচনা ও দোষচর্চার কথা, সে-ই তাকে বোকা বলবে। এক্ষেত্রে কারণ একটাই, তা হলো স্বর্ণশিল্পীর তুলাদণ্ডকে তার নিজস্ব কর্মসীমানার বাইরে অনধিকার চর্চা হিসেবে ব্যবহার করায় তার কাঁটা ভেঙ্গে গেছে। সেটা তুলাদণ্ডের দোষ নয়। তুলাদণ্ড ব্যবহারকারীর দোষ। [মোকাদ্দিমায়ে ইবনে খালদুন, অনুচ্ছেদ কালাম শাস্ত্র, পৃষ্ঠা-৩৪]

ইসলাম ও সেক্যুলারিজম এক নয়, এতদুভয়ের মাঝে অনেক ব্যবধান আছে, কথাটা পূর্বেই বলেছি। ব্যবধানটা হলো, ইসলাম বলে বুদ্ধিকে তোমরা বুদ্ধির কর্মক্ষেত্রের ভেতর ব্যবহার করো, এর বাইরে ব্যবহার করো না। কারণ সে তার কর্মক্ষেত্রের বাইরে কাজ করতে সক্ষম নয়। সেই ক্ষমতা তার নেই। এরপরও যদি তাকে তার কর্মক্ষেত্রের বাইরে ব্যবহার কর, তাহলে সে তার কাজ সঠিকভাবে করবে না, তাতে গোলমাল বাঁধিয়ে দিবে। যে বিষয়ের জন্য যে কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছে, সে কম্পিউটার সে নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যবহার করলেই সুন্দরভাবে কাজ করবে। প্রশ্ন করলেই সাথে সাথে সঠিক উত্তর দেয়া শুরু করবে। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানবসমাজে যে বিষয় সেট করেননি, মানব সমাজের উর্ধ্বে রেখে যে বিষয় লাভের জন্য ওহীকে তৃতীয় মাধ্যম বানিয়েছেন, সেখানে বুদ্ধিকে ব্যবহার করা হলে সে যে ভুল ও এলোমেলো জবাব দিবে তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। বুদ্ধির সীমানার উর্ধ্বের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তো কুরআনুল কারীম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুমহাণ মনীষী মহানবী হযরত মুহাম্মদ স.। এই মর্মে ইরশাদ হয়েছে-“আপনার প্রতি আমি কুরআনুল কারীমকে নাযিল করেছি হক হিসেবে এইজন্য যে যাতে করে আপনি মানবসমাজে (সৃষ্ট সমস্যাবলীর) সঠিকভাবে বিচার মিমাংসা করতে পারেন।”

   আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মানবজাতির কল্যাণের জন্য নাযিলকৃত এই পবিত্র কুরআনই আমাদেরকে বলে দিবে-- কোন্টা সঠিক, কোন্টা সঠিক নয়; কোন্টা কল্যাণকর, কোন্টা কল্যাণকর নয়। সব বিষয়ের প্রকৃত সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান শুধুমাত্র বুদ্ধির থলেতে খুঁজে  পাওয়া যাবে না, এর জন্য অবশ্যই ওহীর ধারস্থ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বুদ্ধিমান মানুষেরা কখনো এর বিকল্পের কথা ভাবতেও পারে না।

বুদ্ধি চিন্তাজগতের মানদণ্ড নির্ণয়ে অক্ষম

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যশনাল’ একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নাম। এর প্রধান কার্যালয় প্যারিসে। ‘৯১ সালের জুনের দিকে ঐ প্রতিষ্ঠানের একজন রিসার্স স্কলার সার্ভে (জরিপ) করার জন্য পাকিস্তান এসেছিলেন। তিনি আমার কাছে সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য এসে কেন যেন একটি কথা বলেছিলেন, যেকথাটি প্রায়ই আমার মনে পড়ে। সেটা হলো, তিনি বলেছিলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো চিন্তার স্বাধীনতা। চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষেই আমরা এ পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি। মুক্তচিন্তা চর্চার কারণে অনেকেই বর্তমানে বন্দীখানায় আছে। তাদেরকে বের করে আনার জন্য আমরা জোরচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং যাব। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে, চিন্তার স্বাধীনতা একটি অবিসংবাদিত বিষয়। এ নিয়ে কারও মাঝে কোনো ধরনের সংশয় বা মতভেদ থাকার কথা নয়। এহেন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন স্তরের মানুষের ধারণা ও মানসিকতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য আমাকে পাকিস্তান পাঠানো হয়েছে। আমি জেনেছি, আপনার সাথে বিভিন্ন্ স্তরের অনেক বুদ্ধিজীবির সম্পর্ক রয়েছে। তাই আমি আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”

   আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে এ সমীক্ষা করছেন? জবাবে তিনি বললেন, এর মাধ্যমে আমরা একথাই জানতে চাই যে, চিন্তার স্বাধীনতার বিষয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত কী?

জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তিনি এ কাজের জন্য করাচিতে একদিন এবং ইসলামাবাদে একদিন থাকবেন।

   আমি তাকে বললাম, দেখুন আপনি চিন্তার স্বাধীনতা সম্পর্কে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ধারণা জরিপ করার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের এই দেশে এসেছেন। এখান থেকে ফিরে গিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে তা কর্তৃপক্ষ বরাবরে উপস্থাপন করবেন। আপনি কি মনে করেন যে, দু’তিনটি শহরে মাত্র দু’তিন দিন অবস্থান করাই আপনার মহতী কাজের জন্য যথেষ্ট? তিনি বললেন, দেখুন এটা তো খুবই স্পষ্ট কথা যে, দু’তিন দিনের মধ্যে সকলের ধ্যান-ধারণার সাথে অবগতি লাভ করাটা সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি অনেক বুদ্ধিজীবির সাথে আলোচনা করেছি, কারও কারও সাক্ষাৎকার নিয়েছি। একই ধারাপরিক্রমায় এলাম আপনার কাছে। অনুগ্রহপূর্বক আপনিও এ বিষয়ে আমাকে মতামত দিয়ে সহযোগীতা করুন।

আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, আপনি করাচিতে ক’জনের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছেন? জবাবে বললেন, তিনজনের  সাথে। আপনি হলেন চতুর্থ ব্যক্তি। আমি বললাম , আপনি শুধুমাত্র এ চারজনের মতামতের ভিত্তিতে সমগ্র দেশটি নিয়ে একটি মূল্যবান রিপোর্ট করবেন যে, চিন্তার স্বাধীনতা সম্পর্কে পাকিস্তানবাসীদের ধারণা এরূপ। দয়া করে অমাকে মাপ করবেন। রিপোর্ট পেশ করার পূর্বেই আপনার ভবিষ্যতের জরিপের সত্যতার বিষয়ে আমার খুবই সন্দেহ হচ্ছে। কারণ আপনি রিসার্চ করছেন। রিসার্চের কোনো কাজই তো এরূপ অনুমানের ভিত্তিতে হয় না, হতেও পারে না। এ কারণেই আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। দয়া করে আমাকে মাপ করুন!

   আমার এই বক্তব্য শুনে তিনি আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বললেন, ‘অনুগ্রহপূর্বক আমাকে মাপ করবেন, আসলে আমার হাতে সময় কম ছিল বলেই এমনটি করা হয়েছে।’

   তখন আমি তাকে বললাম, আপনার হাতে যখন সময় নেই তখন গুরুত্বপূর্ণ এই কাজে আপনার হাত দেয়ার কী প্রয়োজন ছিল? এ কাজ না হতে দিলে কি হতো না? আমার এবারের কথা শুনে তিনি আবারও পীড়াপীড়ি শুরু করে দিয়ে বললেন, জনাব! যদিও আপনার কথাই শ’ভাগের শ’ভাগই সত্য, তবু আপনি কষ্ট করে আমার ক’টি প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন।

   আমি তাকে আবারও বললাম, আমি আপনার এই অসম্পূর্ণ ও বিন্যাসমুক্ত জরিপকাজে কোনো ধরনের সহযোগীতা করতে অক্ষম। তবে আপনি অনুমতি দিলেই কেবল আমি আপনার এই সংস্থা সম্পর্কে দু’টি কথা জিজ্ঞেস করতে পারি। এতে তিনি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বললেন, মূলতঃ আমিতো আপনার কাছে এলাম ক’টি প্রশ্ন নিয়ে। আপনি যদি তার জবাব দিতে অসম্মত হন, তাহলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন।

   আমি তাকে বললাম, আপনি যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমাদের এখানে এসেছেন, আপনার বক্তব্য অনুযায়ী তা চিন্তার স্বাধীনতার পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান। চিন্তার স্বাধীনতা একটি সর্বগ্রাহ্য ও প্রশংসনীয় বিষয়, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার একটি প্রশ্ন আছে। তা হলো, আপনার প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে এ চিন্তার স্বাধীনতার ধারণা কি সম্পূর্ণ নিরংকুশ, নাকি তা শর্তারোপিত হওয়া উচিৎ? জবাবে ঐ স্কলার বললেন, জনাব! প্লিজ, আপনার কথা আমি বুঝতে পারিনি। দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলুন।

   আমি বললাম, মানে চিন্তার স্বাধীনতার এ ধারণা কি এতটুকু নিরংকুশ যে, এই অধিকারের বলে মানুষের মনে যখন যে চিন্তার উদয় হবে, তখনই সে মানুষের মাঝে তার প্রচার করে যাবে এবং এর প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে, আকৃষ্ট করবে? ধরুন, আমার কল্পনায় এলো যে, সমাজের পুঁজিপতিরা অঢেল সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রেখেছে, তাই গরীব-দুঃখী-অসহায় মানুষের এই অধিকার ও স্বাধীনতা থাকা চাই যে, তারা পুঁিজপতিদের ধনরাশি ডাকাতি করে নিয়ে যেতে পারবে। কারণ মেহনতী শ্রমিকদের ঘাম ঝরানোর মধ্য দিয়েই পুঁজিপতিদের ঐশ্বর্যের এই আকাশচুম্বি অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। এখন আমার মধ্যে উদয় হওয়া এই চিন্তা যদি আমি মানুষের মধ্যে প্রচার করা আরম্ভ করি, তাহলে আপনার প্রতিষ্ঠানের চিন্তার স্বাধীনতার ধারণা কি আমার এ জাতীয় চিন্তাধারার পক্ষে সমর্থক ও সহায়ক হবে? নাকি এর বিপরীত হবে? আমার এই প্রশ্নের জবাবে ঐ স্কলার বললেন, না, আমাদের চিন্তার স্বাধীনতার ধারণা কখনো এ জাতীয় চিন্তাধারাকে সমর্থন করেনা। আমি প্রশ্ন করলাম, তাহলে চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে কি আপনার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম-কানুন আছে?

   জরিপকারী ঐ স্কলারের ‘না বোধক’ জবাব পেয়ে আমি তাকে বললাম, জনাব! আপনাদের চিন্তার স্বাধীনতার ধারণাটি যেহেতু সম্পূর্ণ নিরংকুশ নয়, সেহেতু আমি স্পষ্টভাবে আপনার কাছে একটি কথা জানতে চাই যে, এ বিষয়ে কিছু আবশ্যকীয় শর্তাবলী থাকুক--আপনি কি তাতে সম্মত? জবাবে তিনি বললেন, জ্বী, অবশ্যই। যেমন যেক্ষেত্রে চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার অন্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, সেক্ষেত্রে এই অধিকারের সীমানা সংকুচিত হওয়া চাই। তখন আমি তাকে বললাম, আপনি আপনার ধারণা থেকেই এই শর্তটা আরোপ করলেন, এভাবে কোনো আল্লাহভীরু মানুষ যদি মনে করেন যে, মহৎ কিছু উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন কিছু কঠিন ও কড়াকড়ি বিধি-নিষেধের অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়, আর তাই এসব মহৎ উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের  জন্য তিনি কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম-নীতি আরোপিত করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তার এ জাতীয় চিন্তা কি চিন্তাস্বাধীনতার মর্যাদা পাবার যোগ্য হবে?

   দ্বিতীয়তঃ আরেকটি কথা আছে, তা হলো- আপনি যেমন আপনার বুদ্ধি ও বিবেক অনুযায়ী চিন্তার স্বাধীনতার ধারণার উপর একটি শর্ত জুড়ে দিলেন, এভাবে আপনি ছাড়া অন্য কেউ যদি অন্য কোনো শর্ত আরোপ করতে চায়, তাহলে সেই শর্ত আরোপের অধিকার তার থাকা কি উচিৎ নয়? অথবা উচিৎ নয় কি এমন কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা, যার জন্য আপনার বিবেকনিঃসৃত মতামত আমলযোগ্য হবে বা প্রত্যাখ্যানযোগ্য হবে? তিনি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেলেন, কোনো কিছু বললেন না। এরপর তাকে বললাম, এই তো কিছুক্ষণ পূর্বে আপনি স্বীকার করলেন যে, চিন্তার স্বাধীনতার ধারণায় কিছু শর্ত থাকা উচিৎ। এখন আমি যা জানতে চাই, তা হলো- সেই শর্তগুলো কী কী? এ বিষয়ে সিদ্ধান্তকারী  কর্তৃপক্ষ কে বা কারা? আপনার কাছে এই শর্তারোপের কি কোনো মাপকাঠি আছে, যার ভিত্তিতে আপনি এই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন যে, এই-এই শর্ত এখানে অরোপনযোগ্য এবং ঐ ঐ শর্ত আরোপনযোগ্য নয়? আপনি আমাকে এমন একটি ধরাবাঁধা নিয়ম-নীতি বলে দিন, যার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যাবে যে, এই শর্ত আরোপ বৈধ এবং ঐ শর্ত আরোপ অবৈধ।

   আমার এসব কথা শুনার  পর ঐ স্কলার বললেন, জনাব! আমাকে মাপ করবেন। আমি কখনো এসব বিষয়ের উপর কোনো ধারাবাহিক চিন্তাভাবনা করিনি। 

   তার পক্ষ থেকে এহেন জবাব পেয়ে আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আপনি এত বড় একটি বিশ্বসংস্থার  সাথে জড়িত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ বিষয়ের জরিপের জন্য দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ আপনি চিন্তার স্বাধীনতার কর্মক্ষেত্র ও কর্মসীমানা কতটুকু হতে পারে, সেই মৌলিক ও অপরিহার্য প্রশ্নেরই উত্তর জানেন না, এটা কেমন কথা! এর পরিসর ও সীমানা নিয়েই যদি আপনার জ্ঞান না থাকে, তাহলে আপনার এই জরিপ ফলপ্রসূ হবে বলে আমার মনে হয় না। আপনার প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে যে, আপনি প্রয়োজনে আপনার অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনা করে আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর জানাবেন। আপনার কাছে এই আশা পোষণ করছি। তিনি “ঠিক আছে জানাবো” বলে বিদায় নিলেন।

ওহী-ই সত্যাসত্য নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি

মতবিনিময়ের পর জরিপকারী চলে গেলেন। আমি অপেক্ষায় আছি তার জবাব প্রাপ্তির। কিন্তু না, আজ পর্যন্ত আমি তার জবাব পেলাম না। জবাব পাবই বা কি করে? কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, কিয়ামত পর্যন্ত তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। পেশ করতে পারবেন না এমন কোন Universally Applicable yardstick বা বিশ্বজনীন মাপকাঠি। কারণ, আপনি একটা মাপকাঠি নির্ধারণ করলে আরেকজন আরেকটা মাপকাঠি নির্ধারণ করবে। তাই আমি নিঃসন্দেহে এবং সাহসী কণ্ঠেই একথা ঘোষণা করতে পারি যে, একমাত্র ওহী ব্যতীত পৃথিবীর কাছে আর কোনো বিশ্বজনীন মাপকাঠি নেই, যা এই অস্পষ্ট ধারণার বৈধতার সীমা নির্ধারণ করতে পারে।

   আপনি যদি দর্শনের গ্রন্থ পড়েন, তাহলে তথায় দেখতে পাবেন--আইনের সাথে নীতি ও চরিত্রের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইনজীবীদের একটি গ্র“পের অভিমত হলো, নীতি ও চরিত্রের সাথে আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা সম্পূর্ণই ভুল। তারা বলে থাকেন - Should/Should Not বা উচিৎ-অনুচিৎ ইত্যাদি শব্দগুলো মূলতঃ মানুষের প্রবৃত্তির তৈরী । এছাড়া এ জাতীয় শব্দের কোনো বাস্তবতা নেই। কারণ, যে যুগে যে জনগোষ্ঠী যে রীতি নীতিকে অবলম্বন করবে, তা-ই তার জন্য সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত। আমাদের নিকট এমন কোনো মাপকাঠি নেই, যার উপর ভিত্তি করে আমরা একথা বলতে পারি যে, অমুক কাজ বৈধ আর অমুক কাজ অবৈধ। 

   আইন শাস্ত্রের একটি প্রসিদ্ধ টেক্স্টবুকের নাম হলো- Jurist rudeness. এই গ্রন্থে এ বিষয়ের আলোচনার শেষ দিকে একটি কথা লেখা আছে যে, এ সমস্ত বিষয়ের (ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়করণ) মানদন্ড হওয়ার জন্য মানব সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মই শুধুমাত্র উপযোগী বিষয়। কিন্তু যেহেতু আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে ধর্মের সম্পর্ক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য, তাই ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থার সাথে এর বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। মূলতঃ এ কারণেই আমরা বিষয়টাকে মেনে নিতে পারি না। 

   আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়লো । ঘটনাকে এখানে উপমা হিসাবে পেশ করা যায়। আমি আগেও উল্লেখ করেছি যে, বৃটেনের আইনসভায় সমকামিতার বিল পাশ হয়েছে। বিলটি অনুমোদন লাভের সময় এর যথেষ্ট বিরোধিতাও লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি এই বিলটি পাশ হওয়ার ঔচিত্য ও অনৌচিত্য নির্ধারণের জন্য একটি কমিটিও গঠিত হয়েছিল। ঐ কমিটি কর্তৃক একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছিল। ফ্রিডম্যানের (Fridman) বিখ্যাত গ্রন্থ The Icgai Theory বইতে রিপোর্টটির সারাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, ঐ কমিটি সম্পূর্ণ রিপোর্ট লেখার পর এ কথাগুলোও লিখেছিল-“যদিও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই বিষয়টি সাধারণ মানুষের চোখে খুবই নোংরা মনে হয়, তবুও আমরা যেহেতু ইতিপূর্বে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছি যে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে আইনের হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার নেই, তাই এই নীতির আলোকে আমরা যখনই কোনো অন্যায়-অপরাধের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করব, তখনই তাকে বাধা দেয়ার মতো কোনো দলীল-প্রমাণ আমাদের হাতে থাকবে না। তবে হ্যাঁ, অন্যায়-অপরাধকে অভিন্ন ও এক মনে করলে, এই বিলের বিরুদ্ধে রায় দেয়া যায়। সুতরাং আমাদের কাছে এই বিলের বিরোধিতা করার কোনো উপায় নেই। অতএব বিলটি পাশ হওয়া উচিত।”

   কথাটা আগেও বলেছি যে, বুদ্ধির ঘোড়ার দৌড় যেখানে গিয়ে শেষ হয়, সেখান থেকেই ওহী তার কার্যক্রম আরম্ভ করে। দীপ্যমান সূর্য্যরে ন্যায় স্পষ্ট এই মহাসত্য বিষয়টিকে স্বীকার করার পর পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর কোনো বিধান যুক্তিগ্রাহ্য হচ্ছে না বা বুঝে আসছে না বলে প্রত্যাখ্যন করা স্পষ্ট বোকামী ছাড়া আর কিছুই না। কারণ, ওহীর বিধানই তো অবতীর্ণ হয়েছে সেই স্থানের জন্য-যেখানে যুক্তি অচল। যেখানে যুক্তির ঘোড়া অচল, সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল স.-এর মাধ্যমে আল-কুরআনুল কারীম নাযিলের আয়োজন করার নয়তো আর কোনোই প্রয়োজন ছিল না। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজের কিছু সংখ্যক শিক্ষিত মানুষও বলে থাকেন যে, আল-কুরআনের অমুক বিধানটা আমার বুঝে আসছে না। যে কারণে তা আমি মানতে রাজি নই। তাদের এ ধরনের কথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হওয়ায় প্রত্যাখ্যাত হতে বাধ্য।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি : কুরআনে আছে, হাদীসে আছে

আমাদের শিক্ষিত সমাজের অনেকের মনে প্রায় সময়ই একটি প্রশ্ন উঁকি দিয়ে উঠে। তা হলো এই যুগটা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান আমাদেরকে উন্নতির ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো ফর্মুলা কেন পবিত্র কুরআন ও হাদীসে নেই? কেন কুরআন ও হাদীস এ বিষয়ে নীরব ভুমিকা পালন করছে? যেমন ধরুন, হাইড্রোজেন বা আণবিক বোমা কিভাবে তৈরি করতে হবে-- এ বিষয়ে কোনো দিক-নির্দেশনা পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিশাল জগত মন্থন করেও পাওয়া যায় না কেন?

   যাদের হৃদয়ে এ জাতীয় প্রশ্নের অবতারণা হয়, উল্লেখিত নীতির আলোকে তাদের এই প্রশ্নের জবাব এসে গেছে। এ জাতীয় প্রশ্ন তাদের মধ্যে দেখা দেয়ার কারণ হলো এই যে, আমাদের সমাজে এমন কিছু লোকের অবস্থান রয়েছে, যারা মানসিক হীনমন্যতার শিকার। তারা বলে থাকে, উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জনের ধারাবাহিকতায় মানুষ এখন চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমিয়েছে। অথচ কুরআন ও হাদীস আমাদেরকে মহাকাশ ভ্রমণের কোনো নীতি বা ফর্মুলা বলে দেয় নি। তা কেন?

   উত্তর হলো, পবিত্র কুরআনুল কারীম আমাদেরকে এ জাতীয় বিষয়ের দিক নির্দেশনা দেয় না এ কারণে যে, এগুলো নিছক বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সীমানায় আবদ্ধ বিষয়। মানুষকে দেয়া আল্লাহ্ পাকের মেধা খাটালেই এসব বিষয়ের জ্ঞান অনায়াসে লাভ করা অসম্ভব কিছু নয়। তাই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এ জাতীয় বিষয়কে মানুষের ব্যক্তিগত চেষ্টা ও বুদ্ধির কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। যেকেউ যতদূর চেষ্টা করবে, বুদ্ধির সার্থক ব্যবহার ঘটাবে, সে এ পথে ততদূর অগ্রসর হতে পারবে। পক্ষান্তরে আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে বুদ্ধির সীমানার উর্ধ্বের বিষয়াবলী সমাধানের জন্য। যে সকল বিষয়ে বুদ্ধি সমাধান দিতে অক্ষমতা ও অপারগতা প্রকাশ করবে, আল-কুরআন শুধুমাত্র সেসব বিষয়েই সমাধান দিতে অবতীর্ণ হয়েছে।

   উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, “ইস্লামাইজেশন অফ লস”- এর দর্শন হলো, আমরা আমাদের গোটা মানবজীবনকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে চাই। যাতে সার্বিক উন্নতির শিখরে পৌঁছা সম্ভব হয়।

ইসলামের বিধান তিন ভাগে বিভক্ত

পরিশেষে আপনাদের সামনে আমি আরেকটি কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এ পর্যন্ত যা বললাম, তা বুঝে আসার পর আরেকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, আমরা চৌদ্দশ’ বছরের পুরনো জীবনব্যবস্থা কিভাবে ফিরিয়ে আনবো? ওই পুরনো জীবনব্যবস্থাকে আমরা একুশ শতকের এই আধুনিকই শুধুূ নয়, অত্যাধুনিক কালে কি করে খাপ খাওয়াবো, প্রয়োগ করবো? আমাদের জীবনের চাহিদা কি দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে না? এ জাতীয় আরও কিছু অমূলক প্রশ্ন দেখা দেয় মূলতঃ সংশ্লিষ্ট প্রশ্নকারীর ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের সাথে পরিচয়হীনতা ও অজ্ঞতার কারণে।

   আমাদের মনে রাখতে হবে- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম তার বিধান সমূহকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে। প্রথম ভাগে সেসব বিষয়Ñযেখানে কুরআনুল কারীম বা হাদীসে মুতাওয়াতিরের (অকাট্য হাদীস) স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত আগম্য সমগ্র মানবজাতির জীবনে যত পরিবর্তনই আসুক না কেন, কোনো ক্ষেত্রেই এ সকল বিধি-বিধানের বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন-পরিবর্ধন হবে না। এমনকি তা কল্পনাও করা যায় না ।

   দ্বিতীয় ভাগে সেসব বিষয়--যেখানে ইজ্তিহাদের(গবেষণা) অবকাশ রয়েছে, যাতে কুরআন ও হাদীসের অকাট্য বর্ণনা পাওয়া যায় না। এসব বিষয়ে ইসলামী বিধি-বিধানে বেশ স্থিতি-স্থাপকতা রয়েছে।

   আর তৃতীয় ভাগে হলো সে সকল বিষয়--যে সব বিষয়ে কোনো ওহী বা শরয়ী বিধানগত দিক-নির্দেশনা নেই।

   যদি প্রশ্ন করা হয়, কুরআন এসব বিষয়ে কোনো ফয়সালা দেয়নি কেন? তাহলে এর জবাব হবে তা-ই, যা পূর্বেও বলা হয়েছে, অর্থাৎ এসব বিষয়ের ফয়সালা আমাদের বুদ্ধি ও বিবেকের উপর আল্লাহ্পাক ছেড়ে দিয়েছেন বলেই কুরআন এ বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করেছে। এর সীমানা এত বেশি প্রশস্ত ও ব্যাপক যে, মানুষ সকল যুগেই নিজ অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই শূন্য ময়দানে প্রগতি ও উন্নয়নের সর্বশীর্ষে আরোহণ করতে পারে। মিটাতে পারে সব যুগেরই চাহিদা। ইসলামের যেসব বিধি-বিধানে ‘ইজতিহাদের’ অবকাশ রয়েছে, যুগ ও কার্যকারণের পরিবর্তনের কারণে সেসব বিষয়ে বিধান পরিবর্তন হতে পারে। তবে হ্যাঁ, তাতে মৌলিক কোনো প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন কখনো হবে না। কারণ, মানবজাতির ফিত্রাত বা সহজাত প্রবৃত্তির সাথে সামাঞ্জস্য রেখেই এসব বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। কোনো কারণে মানুষের পরিবেশ-প্রতিবেশ পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তার সৃষ্টিগত স্বভাব কখনো পরিবর্তন হবে না। তাই এসব বিষয়েও কোনো পরিবর্তন হবে না।

   উপরোক্ত আলোচনার পর একথাই প্রমাণিত হয় যে, শরীয়ত আমাদেরকে যতদূর অবকাশ দিয়েছে, সেই অবকাশের বৃত্তের ভেতর থেকে আমরা আমাদের যুগ-চাহিদার বিভিন্ন প্রয়োজন মিটাতে পারি।

ইজতেহাদ শুরু হবে যেখান থেকে

শরয়ী ব্যাপারে ইজতেহাদ বা গবেষণা যেখানে ইচ্ছা সেখানেই করা যাবে না। ইজতেহাদের নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র আছে। তা হচ্ছে মানবজাতির যেসব সমস্যার সমাধানে শরীয়তের অকাট্য দলিল-প্রমাণ অনুপস্থিত, শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই ইজতেহাদ করা যাবে। পক্ষান্তরে যেখানে অকাট্য দলীল-প্রমাণ আছে, সেখানে ইজতেহাদ বা বুদ্ধির ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, তাহলে তা হবে শরয়ী দলীলের বিরুদ্ধাচারণ--যা স্পষ্ট সীমালঙ্ঘনের নামান্তর। এর মাধ্যমে দ্বীন বিকৃত করার জঘন্য ও ধিকৃত পথ খুলে যায়। নীচে আপনাদের সামনে এ নিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।

শুকর হারাম হবে, না হালাল?

পবিত্র কুরআনুল কারীমে শুকরকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। হারাম হওয়াটা একটা শরয়ী বিধান। এই বিধানের যৌক্তিকতা ও কার্যকারণ অনুসন্ধান করা বাতুলতা বৈ নয়। সমাজের কিছু সংখ্যক জ্ঞানপাপী বলে থাকে যে, পবিত্র কুরআন নাযিলের সময়ে শুকর অত্যন্ত নোংরা ছিল, নোংরা পরিবেশে পালিত হতো এবং ময়লা আবর্জনা তাদের আহার্য্য ছিল বলেই শুকরকে কুরআনুল কারীমে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বর্তমানে অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত খামারে (ঐবধরমবহরপ ঋধৎস) উত্তম খাদ্য দিয়ে শুকর পালিত হয়। সুতরাং শুকর-সম্পর্কিত কুরআনের বিধান বর্তমানে কার্যকর না রাখাই উচিত। ফলতঃ এখানেও বুদ্ধির কর্মক্ষেত্রের বাইরে তাকে ব্যবহার করে মানব জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের চিন্তা-চেতনা শরয়ী বিধানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে।

সুদ ও ব্যবসার তাত্ত্বিক পার্থক্য

অনুরূপ সুদকে পবিত্র কুরআনে যখন হারাম করা হয়েছে, তখন তা বুদ্ধির বোধগম্য হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় তা হারামই থাকবে। দেখুন, পবিত্র কুরআনে তৎকালীন আরবের মুশরিকদের কথা উদ্ধৃত হয়েছে। মুশরিকরা বলত-“নিশ্চয়ই ক্রয়-বিক্রয় সুদের মতোই।” ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে যেমন মানুষ লাভবান হয়, তেমনি সুদের মাধ্যমেও লাভবান হয়ে থাকে। কিন্তু আল-কুরআনুল কারীম তাদের জবাবে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদের পার্থক্য বর্ণনা করেনি। বরং শুধু একথা বলে দিয়েছে যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম। তাই এক্ষেত্রে তোমরা নাক গলাবে না। আল্লাহ্পাক যেহেতু ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন, তাই তা হালাল। আর যেহেতু সুদকে হারাম করেছেন, তাই তা হারাম গণ্য হবে। এখানে যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করা মানে বুদ্ধিকে তার কর্মক্ষেত্রের বাইরে পরিচালিত করা। 

   একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, একদা ভারত উপমাহাদেশীয় একজন গায়ক হজ্বে গিয়েছিলেন। গাড়ী-ঘোড়ার প্রচলন তখন ছিল না বলে হজ্বের পর উটে বা পদব্রজে মদিনা শরীফ যাবার সময় কয়েকটি মন্জিল অতিক্রম করতে হতো। গায়ক হাজ্বী যখন মদিনার পথে একটি মন্জিলে রাত্রি যাপনের জন্য অবস্থান করলেন, তখন একজন বেদুঈন গায়ককে বেসুর আওয়াজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে শুনলেন। হারমোনিয়ামের সাথে গানের তাল ও লয়ের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। উপমহাদেশীয় ঐ গায়ক তা শুনে মনে মনে বললেন-“আজ আমি প্রকৃত অর্থেই বুঝেছি- প্রিয়তম রাসূল (স.) কেন সঙ্গীতকে হারাম বলেছিলেন। তিনি যদি আমার গান শুনতেন, তাহলে নিশ্চয় হারাম বলতেন না!”

   কী অদ্ভুত চিন্তা! বর্তমানে আমাদের মাঝে এ জাতীয় চিন্তার উন্নতি হচ্ছে। এই কথিত উন্নতিকেই অনেকে ইজ্তেহাদ বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে থাকে। নিঃসন্দেহে এসব কাজ নিজের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অপব্যবহার মাত্র।

এ যুগের ইজতেহাদ

আমাদের এখানে একজন প্রসিদ্ধ চিন্তাবিদ আছেন। চিন্তাবিদ বলার কারণ হলো, তাকে তার সমাজের মানুষ চিন্তাবিদ বলেই চিনে। আল-কুরআনে চুরির শাস্তিবিধানে বলা হয়েছে যে, চোর পুরুষ হোক বা মহিলা হোক তাদের হাত কেটে দাও। ঐ চিন্তাবিদ উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেনঃ চোর বলতে এখানে সেসব পূঁজিপতিকে বুঝানো উদ্দেশ্য, যারা বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বানিয়ে রেখেছে। আর এখানে হাত বলতে তাদের ইন্ডাস্ট্রি বুঝানো হয়েছে। আর কর্তন বলতে বুঝানো হয়েছে এসব ইন্ডাস্ট্রি জাতীয়করণ করাকে। সুতরাং আয়াতটির অর্থ দাঁড়াবে এই যে, পুঁজিপতিদের সমস্ত ইন্ডাস্ট্রিকে জাতীয়করণ করতে হবে। তাহলে চুরির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। 

   দেখলেন তো ইজ্তেহাদ! এ জাতীয় ইজ্তেহাদ সম্পর্কেই আল্লামা ইকবাল বলেছেন (অনুবাদ), 

“কথিত জ্ঞানীর ইজতেহাদ খুব ভয়ংকর,

পূর্বসূরীদের অনুসরণই শ্রেষ্ঠতর।

ইজতেহাদের তালবাহানায় প্রাচ্যজন,

শুধুই করে ফিরিঙ্গীদের অনুকরণ।”

   মোটকথা, যতদিন পর্যন্ত আইনের ইসলামীকরণের দর্শন আমাদের অনুসরণ-অনুকরণে খোদাই করা পাথুরে লিপির মতো স্থায়ীভাবে প্রোথিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত এ বিষয়ের শাব্দিক অলোচনা ও ধ্বনি-সর্বস্ব সেমিনার-সিম্পোজিয়াম কস্মিনকালেও ফলপ্রসূ হবে না।

  “Islamization of Laws  বা আইনের ইসলামিকরণ”-এর প্রথম পদক্ষেপ হলো মূলতঃ মানুষের মানস-পটে এই ধারণাটি বদ্ধমূল করে তোলা যে, আইনের ইসলামিকরণ ব্যতীত মানবতার কল্যাণের দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই। মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সকল মুসলিম দেশের দেশীয় আইনের ইসলামিকরণ অপরিহার্য। এই ধারণাটি আমাদের হৃদয়ে এমনভাবে প্রোথিত হওয়া দরকার যে, যেন আমরা বুলেটের সম্মুখেও নির্ভীকচিত্তে দাঁড়িয়ে এই শ্লোগান দিতে পারি। [মাসিক আদর্শ নারী; এপ্রিল, মে, জুন ও আগস্ট ২০০১ সংখ্যায় প্রকাশিত।]

 শেষ কথা

পুস্তিকাটি লেখার ক্ষেত্রে যাদের আন্তরিক উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছি তাঁদের সবার জন্য আল্লাহর কাছে কামনা, তিনি যেন তাঁদের উভয় জাহান শান্তিময় করেন।

পুস্তিকাটি এখন তিন অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে সময়-সুযোগ হলে আরো বৃদ্ধি পেতে পারে--এ আশ্বাস রইলো পাঠকদের প্রতি। তাছাড়া স্বল্প সময়ে প্রকাশের কাজ করার কারণে অনেক মুদ্রণ-ত্র“টি থেকে যেতে পারে, পরবর্তী সংস্করণে সেসব সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।

[কলকাতার কট্টর নাস্তিক লেখক প্রবীর ঘোষের ‘‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’’ বইটির উত্তরে এই বইটি লেখা। ‍পুরো বই পড়ুন অনলাইনেই।

১ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post.html

২য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_27.html

৩য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_55.html

৪র্থ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_83.html

৫ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_32.html

৬ষ্ঠ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_31.html

শেষ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_42.html]


Post a Comment

0 Comments