আল্লাহকে বিশ্বাস করি কেন? (পর্ব-৫)

দ্বিতীয় অধ্যায়

ইসলাম মানবিকতার শত্রু, অসাম্যের ধর্ম?

   জনাব প্রবীর ঘোষ তাঁর “আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না” বইতে ইসলামের কিছু জঘন্য(?) দোষ তুলে ধরে মন্তব্য করেছেন, ইসলাম মানবিকতার শত্রু, ইসলাম সাম্যের ধর্ম নয়, ইসলাম কখনোই মানুষের ধর্ম হতে পারে না। [পৃষ্ঠা-৮৮] অন্যকথায়, যারা ইসলাম পালন করে, তারা মানবিকতার শত্রু, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী, অমানুষ। তাঁর গবেষণামতে ইসলাম নারীকে মনে করে ক্রীতদাসী, মনে করে নারী কেবল ভোগের সামগ্রী; ইসলামে নারী অধিকার-বঞ্চিত, অসাম্যের শিকার, অপমানিত-লাঞ্চিত এবং অবহেলিত। শুধু তা-ই নয়, ইসলাম নারীকে মনে করে শয়তান!

  ধন্যবাদ তাঁকে। তাঁর গবেষণা খুব চমৎকার ফল বের করে এনেছে, যা মানবতার বেশ কাজে লাগবে! তবে যেহেতু মানুষ মাত্রেরই ভুল থাকতে পারে, আর প্রবীর ঘোষ অতিমানব জাতীয় কিছুও নন; ইলসামী কোনো পন্ডিতও নন, সেহেতু আমাদের সুযোগ রয়েছে তাঁর গবেষণা কতটুকু নির্ভুল, তা যাচাই করার।

ধর্মের প্রতি প্রবীর ঘোষের নেতিবাচকতা

ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ। প্রবীর ঘোষের জন্ম ভারতে, এমনকি হিন্দু পরিবারে। এজন্য হিন্দু ধর্ম নিয়ে তাঁর বিস্তর জানাশুনার এবং হিন্দু ধর্মের ভালো-খারাপ দিক নিয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হয়েছে।

ব্যবহারিক শব্দ ‘ধর্ম’ থেকে মানুষ যা পাবার কথা; ধর্মের যে যোগ্যতাগুলো থাকার কথা, হিন্দু ধর্মে তিনি তার অনেকগুলোই অনুপস্থিত দেখেছেন। বরং হিন্দু ধর্মে অনেক অধর্মের ছড়াছড়ির কথা তিনি সসূত্রে তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, যা জেনে আমিও অবাক হয়েছি। আসলে হিন্দু ধর্ম নিয়ে ভালোভাবে জানাশুনার সুযোগ তেমন হয়নি আমার, এই প্রথম তাঁর বই পড়ে যতটুকু জানা হলো।

   যাহোক আমার মনে হয়, অধর্মপূর্ণ হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু  ধর্মের ধাঁধাপূর্ণ ঈশ্বরের ধারণা তাঁকে ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে বাধ্য করেছে, যার ফলে ইসলামের কিছু বিষয়েও তিনি চুলচেরা না জেনে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ইসলামকে যেভাবে তিনি বাজে ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, একজন সত্যিকার মহৎ ব্যক্তি হিসেবে চলার জন্য পরিক্ষামূলকভাবে যদি তিনি ইসলামকে ভালভাবে জেনে মাত্র একবছর ইসলাম-মত জীবন যাপন করেন, তাহলে ইসলামকে বাজে বলা পরের কথা, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে তাঁর মনে কোনো সংশয়ই  থাকবে না।

   ইসলাম ধর্মে জন্ম নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে বলতে পারি, ইসলামকে বাজে বলতে পারে কেবল তারা, যারা পৃথিবীতে অতিরিক্ত ভোগবিলাস চায়, যারা বৈধ-অবৈধ কিছু চিন্তা করতে রাজি নয়; নীতি-নৈতিকতা, শালীনতার যারা ধার ধারে না। একজন সাধারণ ভদ্র মানুষ, তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন, ইসলাম সম্পর্কে ভালভাবে জানলে কখনোই ইসলামকে বাজে, অমানবিক ধর্ম বলতে পারবেন না। সমস্যা হচ্ছে, কিছু দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ দ্বারা বর্তমান বিশ্বে ইসলামের নামে অনেক অপপ্রচার হচ্ছে। অপপ্রচার যারা করছে তাদের ব্যক্তিগত জীবন খোঁজ নিয়ে দেখুন, তারা কতটা সাধু, কতটা মহৎ, কতটা সচ্চরিত্রবান-শালীন বা কতটা নিরপেক্ষ!

ইসলামে নারী

  ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেছেন। তাঁর ভাষায় তাঁর প্রথম অভিযোগঃ “ইসলাম ধর্মগ্রন্থ কোরআন-এ আছে [সূরা নিসাঃ ৩৪], ‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এজন্য যে, তারা (পুরুষরা) তাদের অর্থ ব্যয় করে (স্ত্রীদের জন্যে)....স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদের প্রহার কর।’ কেন প্রহার? স্ত্রী কি পুরুষের ক্রীতদাসী?”[পৃ-৮৭]

   কোরআনের বাক্যের প্রথমাংশের দিকে না লক্ষ্য করে শুধু শেষ অংশের কথা শুনে লেখকের কল্জে ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা প্রায়। প্রথম অংশে তো বলাই হয়েছে পুরুষরা নারীর পরিচালক। দু’টি সঙ্গত কারণে পুরুষরা নারীর উপর প্রভাবশালী।

   প্রথমতঃ পুরুষকে তার জ্ঞানৈশ্বর্য ও পরিপূর্ণ কর্মক্ষমতার কারণে নারী জাতির উপর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যা অর্জন করা নারী জাতির পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। দৈবাৎ কিংবা ব্যক্তিবিশেষের কথা স্বতন্ত্র।

   মনীষী এবং বিজ্ঞানীদের জগতে কয়জন নারী পাওয়া যাবে? অতীত বাদ দিলেও বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সেনাপতি, লেখকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদাগুলো নারীরা খুব কমই অর্জন করতে পারে। নারীর স্বাভাবিক এ ক্ষমতাগত দুর্বলতার কারণে পুরুষকে নারীর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে।

   দ্বিতীয়তঃ ইসলামে নারীর যাবতীয় প্রয়োজনীয়তা পুরণের দায়িত্ব অর্পিত হয় পুরুষের উপর। পুরুষ নিজের উপার্জন কিংবা সম্পদ নারীর জন্যে ব্যয় করে থাকে। প্রথম কারণটি আল্লাহ্ কর্র্তৃক নির্ধারিত ও মানুষের নিজস্ব ক্ষমতা বহির্ভুত। আর দ্বিতীয় কারণটি নিজের উপার্জিত ও ক্ষমতাভিত্তিক। তাছাড়া একথাও বলা যেতে পারে যে, একই পিতামাতার সন্তানদের মধ্যে কাউকে শাসক, কাউকে শাসিত বানানোর জন্য বুদ্ধি ও ন্যায়ের আলোকে দু’টি বিষয় অপরিহার্য ছিলঃ (১) যাকে শাসক বানানো হবে তার মধ্যে জ্ঞান ও কর্মের নিরিখে শাসন কার্যের যোগ্যতা; (২) তার অভিভাবকত্বে শাসিতের সম্মতি। 

   প্রথম কারণটি পুরুষের শাসকোচিত যোগ্যতার পরিচায়ক। আর দ্বিতীয় কারণ শাসিত হওয়ার ব্যাপারে নারীদের স্বীকারোক্তি। কারণ নারীরা যখন বিয়ের সময় নিজের খোরপোষ ও মহরের শর্তে বিয়ের অনুমতি দান করে, তখনই সে তাদের অভিভাবকত্ব মেনে নেয়। একজন অভিভাবক হিসেবে পুরুষ যদি স্ত্রীর মধ্যে অবাধ্যতা খুঁজে পায়, তাহলে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আনুগত্যে আনার প্রচেষ্টা কি তার সাথে ক্রীতদাসী-সুলভ দুর্ব্যবহার? 

   কোরআন তো প্রথমেই তাকে প্রহারের কথা বলেনি। বলেছে সদুপদেশের কথা। সদুপদেশে কাজ না হলেও প্রহারের কথা বলেনি। বলেছে শয্যা বর্জনের কথা, যাতে স্ত্রী সতর্ক হয়ে যায়, বিবাদটি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারে। আর যদি সে এ ভদ্রোজনোচিত শাস্তির পরেও স্বীয় অবাধ্যতা ও দুষ্কর্ম থেকে ফিরে না আসে, তাহলে তৃতীয় পর্যায়ে সাধারণভাবে প্রহারের কথা বলা হয়েছে। এটা কিন্তু নিছক প্রহারের অনুমতি। আর তার সীমা হল এই যে, শরীরে যেন প্রহারের প্রতিক্রিয়া কিংবা জখম না হয়। কিন্তু এই পর্যায়ের শাস্তিদানকেও হযরত মুহাম্মদ স. পছন্দ করেননি, বরং তিনি বলেছেন, ‘ভাল লোক এমন করে না।’

   স্ত্রীর সাথে কোরআনের নির্দেশিত এ আচরণ কি ক্রীতদাসী-সুলভ? না হলে এ প্রসঙ্গে প্রবীর ঘোষের “কেন প্রহার? স্ত্রী কি পুরুষের ক্রীতদাসী?” এ ধরনের মন্তব্য কি ইসলামের প্রতি তাঁর নেতিবাচক মনোভাবের পরিচায়ক নয়?

ইসলাম নারীকে চার স্বামী গ্রহণের অনুমোদন দেয়নি কেন?

ইসলামে নারীর মর্যাদা-প্রশ্নে প্রবীর ঘোষের দ্বিতীয় অভিযোগ তাঁর ভাষায়- “নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখে কোরআন নারীকে একসঙ্গে চারটি পতি গ্রহণের অনুমোদন দিতে পারেনি। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে কোরআন বলছে [সূরা নিসাঃ ৩], ‘বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদের ভালো লাগে, দুই, তিন, অথবা চার।’..... মুসলমান স্বামী চারটি স্ত্রীর উপর যখন-তখন যৌন অধিকার ফলাতে পারে, যার অপর নাম অবশ্যই ধর্ষণ। মানবিকতার উপর ধর্ষণ।”[পৃষ্ঠা- ৮৭]

   ইসলাম পুরুষকে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী গ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে। অথচ মহিলাদেরকে চারজন নয়, দু’জন পতি গ্রহণের অনুমোদনও দেয়নি। কেন অনুমোদন দেয়নি, বিষয়টি নিয়ে একজন সাধারণ মানুষ সামান্য চিন্তা করলেও সহজেই বিষয়টির যৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে পারে। অথচ প্রবীর ঘোষের মত মোটামুটি পণ্ডিত জাতীয় একজন ব্যক্তির পক্ষে তা উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়নি। আমার মনে হয়, বিষয়টি তাঁর ভালোভাবেই উপলব্ধ। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যেই তিনি কথাটি বলেছেন।

আজ ৩১ আগস্ট দুপুরে পরিচিত কয়েকজন ছাত্রকে আলোচ্য প্রশ্নটি, আমি জানি না- এমন একটি ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করি। ওরা ছাত্র হয়েও যে উত্তর গুলো দিল, সেগুলো পাঠকের সমীপে পেশ করছিঃ

   প্রথমতঃ মানুষের বংশ-পরিচয় হয় সাধারণতঃ পিতার পরিচয়ে। একজন পুরুষ চার নয়, দশটি বিয়ে করলেও সন্তানদের বংশ-পরিচয়ে কোনো সমস্যা হয় না। প্রত্যেক সন্তানের পিতা থাকেন তো একজনই, মাতাও থাকেন নির্দিষ্ট। কিন্তু একজন মহিলা চারজন স্বামী গ্রহণ করলে, যদি একই রাতে চারজনের সাথেই মেলামেশা হয় এবং গর্ভে সন্তান আসে, তখন ঐ সন্তান নিয়ে তো পিতারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা ছাড়া সন্তানের পিতৃত্ব পাবে না! তাছাড়া পিতারা হাঙ্গামা করে পিতৃত্ব উদ্ধার করতে পারলেও সে পিতৃত্ব যথার্থ হবে শতকরা পঁচিশ ভাগ! আর পিতারা যুদ্ধ করে পিতৃত্ব উদ্ধার করতে না পারলে সন্তানটি কি চারজনকেই পিতা বলবে? একজন লোকের চারজন পিতা! আর দাদা হবে কয়জন? সর্বোচ্চ ষোল জন! বাহ, নিদারুন বংশ-পরিচয়!

  দ্বিতীয়তঃ মহিলারা মাসের কিছুদিন অসুস্থ থাকে, যাকে আরবিতে ‘হায়েজ’, বাংলাতে ‘ঋতু’ আর প্রচলনে ‘মাসিক’ বলা হয়ে থাকে। এর সময়সীমা তিন থেকে দশদিন। আবার সন্তান প্রসবের পরও তারা সর্বোচ্চ চল্লিশ দিন অসুস্থ থাকে, যাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘নিফাস’ বলা হয়। এ হায়েজ ও নিফাস চলাকালিন ইসলাম-মতে স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা নিষিদ্ধ। চার স্বামী বিশিষ্ট একজন মহিলা যখন এ ধরনের সময়ে পৌঁছে, তখন তার চার চারজন স্বামী স্বীয় জৈবিক চাহিদা পুরনের বিকল্প হিসেবে কি বসে বসে একে অন্যের মাথার উঁকুন খুঁজবে, নাকি অন্য (অবৈধ) পন্থার দিকে ধাবিত হবে? অন্যদিকে একজন পুরুষের যখন একাধিক স্ত্রী থাকে, তখন তাদের কেউ মিলন-নিষিদ্ধ এসব সময়ে পৌঁছলে সে অন্য স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে পারে।

  তৃতীয়তঃ বর্তমান বিশ্ব-জনসংখ্যা জরিপ করলে পুরুষ-মহিলার সংখ্যা সমান হবে? মহিলা কম, পুরুষ বেশি হবে? না, যুদ্ধ-দুর্ঘটনা সহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বের সব দেশে না হলেও অধিকাংশ দেশে পুরুষের তুলনায় মহিলার সংখ্যা অনেক বেশি। এমতাবস্থায় মহিলারা চার চারজন পুরুষ যদি স্বামী হিসেবে দখল করা আরম্ভ করে, তাহলে সব মহিলার চাহিদা কি পুরণ হবে? অনেক অনেক মহিলা থেকে যাবে যাদের ভাগ্যে একজন পুরুষও (স্বামী) জুটবে না, তারা বিবাহ করবে কাকে? যৌন চাহিদা পুরন থেকে তারা আজীবন থেকে যাবে বঞ্চিত। জীবন হবে দুর্বিষহ, দুর্ভোগ্য।

 চতুর্থতঃ একজন মহিলা চারজন স্বামী গ্রহণ করলে একই রজনীতে চারজন পুরুষই ঐ মহিলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কী করুণ পরিণতিই না তার হতে পারে! তাছাড়া চারজন পুরুষকে একজন মহিলা উপার্জন করে খাওয়াতে সক্ষম হবে?

চারজন স্ত্রী বিয়ে করা কি ধর্ষণের নামান্তর?

প্রবীর ঘোষ এ প্রেক্ষিতে কোরআনের যে কথাটি উল্লেখ করেছেন, তা তিনি পুর্ণাঙ্গরূপে উল্লেখ করেননি। কেন, কোন্ মতলবে তা তিনিই বলতে পারবেন। কোরআনের পরিপূর্ণ কথাটি হলোঃ “বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাদের ভালো লাগে, দুই, তিন, অথবা চার। কিন্তু যদি এরূপ আশংকা করো যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটিই.....।”[সূরা নিসাঃ ৩]

   পবিত্র কোরআন বিভিন্ন উপযোগীতার প্রতি লক্ষ্য রেখে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করেছে বটে, তবে সাথে সাথে এ-ও বলে দিয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায় বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর কর। এক হাদীসে মুহাম্মদ স. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি তাদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ কায়েম করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে।’ (মিশকাত, পৃ-২৭৮)

যাহোক জনাব প্রবীর ঘোষ চার স্ত্রী গ্রহণের অপর নাম দিয়েছেন ধর্ষণ, মানবিকতার উপর ধর্ষণ! ধর্ষণ কী? ইসলামের এ বিধান প্রসঙ্গে ‘ধর্ষণ’ শব্দের ব্যবহার দেখে মনে প্রশ্ন জাগল, ‘ধর্ষণ’ বলতে আমরা যা বুঝি; সমাজে, পত্র-পত্রিকায় ‘ধর্ষণ’ যে অর্থে ব্যবহৃত হয় প্রবীর ঘোষের মতে হয়তো সে অর্থ ভুল। তাঁর কাছেই হয়তোবা ‘ধর্ষণ’-এর সঠিক সংজ্ঞা রয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য যে, অনেকেই সে অর্থটা না জেনে অপাত্রে ‘ধর্ষণ’ শব্দ প্রয়োগ করে থাকে।

   আমরা তো জানতাম যে ‘স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক সম্ভ্রমহানি করাই হল ধর্ষণ। কিন্তু প্রবীর ঘোষের প্রয়োগমতে বুঝা যায় তা নয়, বরং বৈধ স্ত্রীর উপর যৌন অধিকার ফলানোই ধর্ষণ। জানি না কোন্ অভিধান থেকে তিনি এ সংজ্ঞা আবিষ্কার করেছেন!

ইসলামে বিবাহ হয় ‘ইজাব-কবুল’ তথা প্রস্তাব প্রদান ও প্রস্তাব গ্রহনের মাধ্যমে। সেটা প্রথম বিবাহ হোক কিংবা চতুর্থ বিবাহ, সব সময়ই। সাধারণতঃ স্বামীর পক্ষ  থেকে প্রস্তাব করা হয়, আর স্ত্রী প্রস্তাব গ্রহণ করে। স্ত্রীর সম্মতি অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিবাহ হবার পর সে স্ত্রীর সাথে স্বামীসুলভ আচরণ করার নাম কিভাবে ধর্ষণ হল, পাঠকরা একটু চিন্তা করে দেখুন। বৈধ স্ত্রীর সাথে জীবন যাপন যদি ধর্ষণ হয়, তবে জোরপূর্বক স্ত্রীভিন্ন অন্য নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটানোর নাম ‘ধর্ষণ’-এর পরিবর্তে কী ব্যবহার করতে হবে, তা প্রবীর ঘোষ বলে দেয়া দরকার ছিল।

   তিনি চার স্ত্রীর উপর যখন তখন যৌন অধিকার ফলানোর নাম দিয়েছেন ধর্ষণ, মানবিকতার উপর ধর্ষণ। তবে এক স্ত্রীর উপর যখন তখন যৌন অধিকার ফলানোর নাম ‘ধর্ষণ’ হতে আর বাধা কী? তার অর্থ বিবাহ মানেই ধর্ষণ? কারণ বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর ‘যখন তখন’ বিবাহ্সুলভ আচরণ অনুমোদিত হয়ে যায়।

   যাহোক এ হল ইসলামের সুন্দর জীবন ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের নিকট বিকৃতভাবে উপস্থাপনের এক হীন প্রবণতা।

ইসলামে নারী পণ্যমাত্র?

প্রবীর ঘোষের তৃতীয় অভিযোগের নমুনা দেখুনঃ

   “ইসলাম ধর্ম নারীকে দেখেছে পণ্য হিসেবে। ভোগের সামগ্রী হিসেবে। মানুষ হিসেবে নয়। তারই পথ নির্দেশ রয়েছে কোরআন-এ। সেখানে বলা হচ্ছে [সূরা বাকারাঃ ২৩] ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র; তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পার।”[পৃ-৮৭]

প্রথমে তিনি বলেছেন, ‘নারী’কে দেখেছে পণ্য হিসেবে। নারী মানে কি শুধু স্ত্রী? নারী মানে সব নারী। অথচ তিনি কোরআন থেকে উদ্ধৃত করেছেন স্ত্রী-সংক্রান্ত বাক্য। কী প্রাসঙ্গিক উদাহরণ!

   ইসলাম ‘নারী’কে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখে বলার অর্থ হচ্ছে, ইসলাম যে কোনো নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করে। ইসলাম সম্পর্কে এ ধরনের অপবাদ দেয়ার কোনো সুযোগ কারো নেই। কারণ স্ত্রী-ভিন্ন অন্য নারীদের সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো:-

  # তোমরা ব্যাভিচারের কাছেও যেওনা। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৩২]

  # ব্যাভিচারিনী নারী ব্যাভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। [ সূরা নূরঃ ২]

   # যারা পছন্দ করে যে, (আল্লাহে) বিশ্বাসীদের মধ্যে ব্যাভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহকালে ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। [সুরা নুরঃ ১৯]

   # (হে মুহাম্মদ!) আল্লাহে বিশ্বাসীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি (পরনারী থেকে) সংযত রখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্যে খুব পবিত্রতা আছে। [সূরা নূরঃ ৩০]

   # (আল্লাহর প্রকৃত বান্দা তারা) .......যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের উপাসনা করে না, আল্লাহ্ যাকে হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যাভিচার করে না।......[সুরা ফোরকানঃ ৬৮]

   # এবং (ভালো তারা) যারা তাদের যৌনাঙ্গ সংযত রাখে, তবে তাদের স্ত্রী এবং মালিকানাভূক্ত দাসীদের ছাড়া, কারণ তারা (এ দু’ক্ষেত্রে) তিরস্কৃত হবে না। এতএব এদের ছাড়া যারা অন্যকে কামনা করে, তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। [সুরা মাআরিজঃ ২৯,৩০,৩১]

   সুতরাং সাধারণভাবে ইসলাম যে কোনো নারীকে পণ্য বা ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখা কখনোই সমর্থন করে না।

আর স্ত্রীদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে প্রবীর ঘোষ ইসলামের মাত্র একটি বাণীই উল্লেখ করেছেন। কোরআনে কি আর কোনো কথা নেই এ প্রসঙ্গে? আমরা একটু দেখিঃ

   # সূরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে আছে, “রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ আর তোমরা তাদের পরিচ্ছদ.....।”

   # একই সূরার ২২৮ নং আয়াতে আছে, “...আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়মানুযায়ী।”

   জনাব প্রবীর ঘোষ বলেছেন, ইসলাম নারীকে মানুষ হিসেবে দেখেনি। তাহলে উপরের বাক্যে নারীকে কী হিসেবে দেখেছে? গরু হিসেবে? নাকি কুকুর বা অন্য কোনো অপাঙ্ক্তেয় প্রাণী হিসেবে?

  # সূরা নিসার ১৯নং আয়াতে আছে, “তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো। কখনো যদি তাদেরকে অপছন্দ করো, তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ্ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।”

    # একই সূরার ৭নং আয়াতে রয়েছে, “পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশি। এ অংশ নির্ধারিত।”

   কোরআনের উপরের বাণীগুলো তো নিশ্চয়ই এটাই প্রমাণ করে যে নারী পণ্যমাত্র; নারী মানুষের পর্যায়ে পড়ে না, নাকি?

নারী যেমন একজন স্ত্রী, নারী ক্ষেত্রভেদে একজন মা-ও। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে কত অবমূল্যায়ন(?) করেছে, অপদস্থ(?) করেছে, কোরআন দ্বারাই তা প্রমাণ করিঃ

   # “তোমরা আমার (আল্লাহর) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, আর সাথে সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তোমাদের পিতা-মাতার”। [সূরা লোকমানঃ ১৪]

   # “আমি মানুষদিগকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ দিচ্ছি। তার মা তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভ ধারণ  করতে ও দুগ্ধ পান ছাড়তে সময় লেগেছে ত্রিশ মাস।” [সূরা আহকাফঃ ১৫]

   # “তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করোনা এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ কর। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না, তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর, যেভাবে তারা আমাকে শৈশব কালে লালন পালন করেছেন।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩,২৪]

   কোরআনের উল্লিখিত বাণীসমূহের সারাংশে কি একথা কোনোভাবে আসতে পারে যে, নারী শুধুই ভোগ্যবস্তু? আর কোরআন স্ত্রীকে শস্যক্ষেত্র বলেছে, সমস্যা কী? কোরআন তো আর আবীরের জন্য প্রবীরের স্ত্রীকে শস্যক্ষেত্র বলেনি! নিজ স্ত্রী যদি ভোগের একটা বৈধ ব্যবস্থা না হয়ে থাকে, তাহলে বিবাহ কেন? জনাব প্রবীরের মতে কোরআন হয়তো একথা বললে ভাল হত যে, তোমরা বিবাহ করে জৈবিক সুখ উপভোগ না করে শুধু শুধু স্ত্রীর চেহারা দেখেই জীবন কাটিয়ে দাও।

   যাহোক কোরআন যদি নারী সম্পর্কে উল্লিখিত কথাগুলো না বলে সবসময় নারী বা স্ত্রীকে ‘শস্যক্ষেত্র’ই বলে যেত, তাহলেই কেবল প্রবীর ঘোষ এমন অভিযোগ করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু এখন তিনি এমন অভিযোগ করার উদ্দেশ্য কেবল এ-ই হতে পারে যে, জনমনে বা ইসলাম সম্পর্কে যাদের পড়াশুনা, জানাশুনা নেই, তাদের মনে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। এটা নিশ্চয়ই একটা দুষ্ট প্রচেষ্টা। এমন দুষ্ট প্রচেষ্টা একজন ভদ্রলোক থেকে কখনোই সংঘটিত হতে পারে না।

পুরুষের জন্য তালাক দেয়ার ব্যবস্থা আছে, স্ত্রীর  জন্য নেই?

জনাব প্রবীর ঘোষের ইসলাম সম্পর্কে চতুর্থ অভিযোগ হল- “মুসলমান স্বামীর ধর্মীয় অধিকার রয়েছে কোনো কারণ না দেখিয়ে যে কোনো স্ত্রীকে শুধু তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করে তাড়িয়ে দেবার। না, শত অত্যাচারের পরও স্ত্রীর কোনো অধিকার নেই অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার, তাকে ‘তালাক’ দেওয়ার। ..... ইসলামে বিয়ে যেহেতু চুক্তি, তাই যে কোনো সময় তা বাতিল হতে পারে। তবে বাতিল করার একমাত্র অধিকার রয়েছে পুরুষের; নারীর নয়।” [পৃঃ ৮৭-৮৮]

ইসলাম নিয়ে প্রবীর ঘোষের গবেষণার দৌড় কতদূর? ভাসা ভাসা জ্ঞান ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে তাঁর কোনো জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। সামান্য বিদ্যা নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে যেই-সেই মন্তব্য করে বসা কতটুকু সমীচীন হচ্ছে, এ নিয়ে তাঁর ভাবা উচিত ছিল। সাধারণতঃ এ ধরনের প্রেক্ষাপটে ব্যবহারের জন্য সুন্দর একটি প্রবাদ আছে। ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’। ইসলাম সম্পর্কে অল্প জ্ঞান তাঁকে ইসলামের প্রতি ভয়ংকরভাবে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।

আমার এক চাচাতো বোন আছেন শাহীন। তাঁকে বিয়ে দেয়ার পর সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর অন্যত্র তাঁর বিয়ে হয়। এখন বেশ ভাল অবস্থায় আছেন। জাকির নামে আমার এক ছাত্র আছে। ওর একটা বোনকে বিয়ে দেয়ার পর ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সম্প্রতি অন্যত্র ওর বিয়ে হয়।

   আমার বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর নানার সাথে ক’দিন আগে পরিচয় হল। তিনি বললেন, তাঁর এ নাতনীর মা এখন তাঁর বাড়িতে। ওর স্বামী থেকে ওকে সম্পর্কচ্ছেদ করে নিয়ে আনা হয়। আমাদের মুসলমান সমাজে সচরাচর স্ত্রীর পক্ষ থেকে এ ধরনের বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। ইসলামে অনুমোদন আছে বলেই ঘটনাগুলো ঘটার সুযোগ পায়। আর প্রবীর ঘোষ কী সুন্দর আক্ষেপ প্রকাশ করেন, “(বিয়ে)বাতিল করার একমাত্র অধিকার রয়েছে পুরুষের; নারীর নয়।”

   পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২২৯ নং বাক্যে আছে, “.......যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবে উভয়ের মধ্যে কারোরই কোনো পাপ নেই।”

   স্বামীকে বিনিময় দিয়ে বিবাহ-বন্ধন থেকে স্ত্রীর এ অব্যাহতি নেয়াকে ইসলামী পরিভাষায় ‘খোল্আ’ বলা হয়। আরবি অভিধান ‘মুজামুল ওসীত’-এ এ শব্দের পরিচয়ে বলা হয়েছে, “স্ত্রী থেকে সম্পদ গ্রহণের বিনিময়ে তালাক প্রদান করাকেই খোল্আ বলে।” অর্থাৎ তালাক গ্রহণেচ্ছু-স্ত্রী স্বামীকে সম্পদ দিয়ে তার বিনিময়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানোকেই খোল্আ বলে। ইসলামের প্রতিটি আইন গ্রন্থের বিবাহ অধ্যায়ে খোল্আ-এর উপর আলাদা পরিচ্ছেদ থাকে।

   কোরআনের উল্লিখিত বাক্যের ব্যাখ্যায় কোরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মাআরেফুল কোরআন’ থেকে বিয়ে ও তালাক সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরছিঃ

   “ইসলামের শিক্ষা এই যে, বিয়ের চুক্তি সারা জীবনের জন্য সম্পাদন করা হয়, তা ভঙ্গ করার মত কোনো অবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা এ সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণাম শুধু স্বামী-স্ত্রী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এতে বংশ ও সন্তানদের জীবনও বরবাদ হয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদও সৃষ্টি হয় এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর এজন্যই এ সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে যেসব কারণের উদ্ভব হয়, কোরআন ও হাদিসের শিক্ষায় সে সমস্ত কারণ নিরসনের জন্য পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

   স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকটি বিষয় ও অবস্থা সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে যে উপদেশ রয়েছে, সেগুলোর সারমর্ম হচ্ছে, যাতে এ সম্পর্ক দিন দিন প্রগাঢ় হতে থাকে এবং কখনো ছিন্ন হতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। অসহযোগীতার অবস্থায় প্রথমে বুঝাবার চেষ্টা, অতঃপর সতর্কীকরণ ও ভীতি প্রদর্শনের উপদেশ দেয়া হয়েছে। যদি এতেও সমস্যার সমাধান না হয়, তবে উভয়পক্ষের কয়েক ব্যক্তিকে সালিস সাব্যস্ত করে ব্যাপারটি মীমাংসা করে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

   কারণ, বিষয়টিকে যদি পরিবারের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তিক্ততা এবং মনের দুরত্ব আরো বেশি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু অনেক সময় ব্যাপার এরূপ ধারন করে যে, সংশোধনের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায় এবং বৈবাহিক সম্পর্কের কাঙ্খিত ফল লাভের স্থলে উভয়ের একত্রে মিলেমিশে থাকাও মস্ত আযাবে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় এ সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়াই উভয় পক্ষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার পথ। আর এজন্যই ইসলামে তালাক ও বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

   ইসলামী শরীয়ত অন্যান্য ধর্মের মত বৈবাহিক বন্ধনকে ছিন্ন করার পথ বন্ধ করে দেয়নি। যেহেতু চিন্তাশক্তি ও ধৈর্যের সামর্থ স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষের মধ্যে অনেক বেশি, তাই তালাকের অধিকারও পুরুষকেই দেয়া হয়েছে; এ স্বাধীন ক্ষমতা স্ত্রীলোককে দেয়া হয়নি। যাতে করে সাময়িক বিরক্তির প্রভাবে স্ত্রীলোকদের মধ্যে অনেক বেশি তালাকের কারণ হতে না পারে।

তবে স্ত্রীজাতিকেও এ অধিকার থেকে একেবারে বঞ্চিত করা হয়নি। স্বামীর জুলুম-অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা তাদের জন্যেও রয়েছে। তারা কাজীর দরবারে নিজেদের অসুবিধার বিষয় উপস্থাপন করে স্বামীর দোষ প্রমাণ করে বিবাহবিচ্ছেদ করিয়ে নিতে পারে। যদিও পুরুষকে তালাক দেয়ার স্বাধীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, কিন্তু এতদসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, এ ক্ষমতার ব্যবহার আল্লাহর নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয় ব্যাপার। একমাত্র অপারগ অবস্থাতেই এ ক্ষমতার প্রয়োগ করা যাবে। হাদীসে বলা হয়েছে--“ইসলামে অনুমোদিত বিষয়সমূহের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে তালাক।”

মুসলমান পুরুষ যে কোনো ধর্মের নারীকে বিবাহ করার অধিকারী?

প্রবীর ঘোষের পঞ্চম অভিযোগ হল, “মুসলমান পুরুষ যে কোনো ধর্মের নারীকেই বিয়ে করার অধিকারী। কিন্তু মুসলমান নারী বিধর্মীকে বিয়ে করার অধিকারী নয়। সত্যিই কী বিচিত্র সাম্য!

   যে ধর্ম মানুষকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সে ধর্ম কখনোই মানুষের ধর্ম হতে পারে না। প্রতিটি অলৌকিক ও অলীক বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম নিয়ে সামান্য পড়াশুনা করলেই দেখতে পাবেন এরা কী প্রচন্ড রকমের মানবিকতার শত্র“। এরা মানুষে মানুষে বভেদ সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে ঘৃণা।”[পৃ-৮৮]

   ভদ্রলোক প্রবীর ঘোষ ইসলামের নামে আগাগোড়া ভুয়া এক অভিযোগ তুলে কী নিকৃষ্টভাবে ইসলামকে মানুষের নিকট ঘৃণিত ধর্ম হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন!

ইসলাম নারীকে শয়তান মনে করে!

তিনি আরেকটি অভিযোগ করেছেন, “কল্পিত স্বর্গ বেহেশতে নারীদের কোনো স্থান হয়নি। বরং মুসলিম নীতি নির্দেশক গ্রন্থ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নারী শয়তানের রূপে আসে আর শয়তানের রূপে যায়।”[পৃ-৮৯]

কী জঘন্য এক মিথ্যা অপবাদ ইসলামের নামে! এসব দেখে মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, নাস্তিক সাধুদের জন্য মিথ্যা বলা কি কারো পক্ষ থেকে অনুমোদিত? নয়তো কথায় কথায় এভাবে মিথ্যা আসে কেন? কোন্ গুরুর কাছ থেকে তাঁরা এভাবে অবলীলায় মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়েছেন?

   ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ বই’র ২৯ পৃষ্ঠায় আছে, “ইসলামে ও খ্রীস্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন পৃথিবীর আদি মানুষ আদমের জন্ম খ্রীস্টপূর্ব ৪০০৪ সালে।”

   তথ্যটি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। ইসলামের কোন্ গ্রন্থে তথ্যটি বর্ণিত হয়েছে? ইসলামের প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভুল গ্রন্থ কোরআন। কোরআন ছাড়া আছে ছয়টি হাদিস গ্রন্থ। বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ। এ সাতটি গ্রন্থের কোথা থেকে তিনি তথ্যটি আহরণ করেছেন, উল্লেখ করেননি কেন? ভুয়া, মিথ্যা, বানোয়াট বলেই নিশ্চয়।

   কোরআনের সূরা বাকারার ২২১ নং বাক্যে বলা হয়েছে, “তোমরা মুশ্রিক (বিধর্মী) নারীদেরকে বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্য মুসলমান একজন ক্রীতদাসীও মুশরিক একজন নারী থেকে শ্রেষ্ঠ, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে।”

   ইসলাম কোনো পুরুষের জন্য বিধর্মী নষ্টা-ভ্রষ্টা নাস্তিক-উশৃঙ্খল নারীকে কিভাবে বৈধ করতে পারে!

   আর “নারী শয়তান রূপে আসে.....” হাদীসখানা জনাব প্রবীর ঘোষ কোন্ হাদীস গ্রন্থ থেকে খুব কাঙ্খিতভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছেন, উল্লেখ করলে তিনি কোনোভাবেই মিথ্যাবাদী বা মিথ্যুক প্রমাণিত হতেন না।

প্রবীর ঘোষকে আর লজ্জা দেয়ার দরকার নেই

প্রবীর ঘোষ তাঁর বইতে ইসলাম নিয়ে অনেক আজে-বাজে মিথ্যা উক্তি-মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে প্রয়োজনীয় কয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ হল। আরো অনেকগুলো বকবকানি আছে, তেমন একটা প্রয়োজন মনে হয় না সেগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁকে আরো লজ্জা দেয়ার।

   ইসলাম ধর্মে নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে তাঁর মনে রয়েছে অনেক আপত্তি-ক্ষোভ-দুঃখ, যা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বইতে। এজন্য এ সম্পর্কীয় একটি নিবন্ধ দিয়ে এ অধ্যায়ের ইতি টানছি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক প্রথম আলো’য় বিগত ৫ মার্চ ২০১০ তারিখে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। লেখকঃ ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান। নিবন্ধের নামঃ ‘ইসলাম নারীর অধিকার সমুন্নত করেছে।’

ইসলাম নারীর অধিকার সমুন্নত করেছে

“ইসলাম নারীর অধিকার সমুন্নত রাখতে দিকনির্দেশক ও পথপ্রদর্শক। আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে ইসলাম নারীদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের সমপর্যায়ের অধিকার দিয়ে সম্মানিত করেছে। ইসলামধর্মের মাধ্যমেই মানুষ প্রথম জেনেছে, যেকোনো মৌলিক অধিকার অর্জন মেয়েদের জন্মগত অধিকার। ইসলামই নারীকে সঠিক ও যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে। প্রাক- ইসলামী যুগে নারীর যখন কোনো সামাজিক অধিকার ছিল না, যখন পুরুষেরা তাকে শুধু ভোগের জন্য ব্যবহার করতো, যখন কন্যাশিশু জন্মগ্রহণকে অপমানজনক মনে করে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো, তখন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ স. নারী ও পুরুষের সমমর্যাদার কথা বললেন। তিনি আল্লাহর বাণী ঘোষণা করলেন, ‘আর যে সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী হোক, যদি সে মুমিন(আল্লাহে-বিশ্বাসী) হয়, তাহলে এমন লোকেরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের বিন্দু পরিমাণ হকও বিনষ্ট করা হবে না।’ (সূরা আন্-নিসা, আয়াত : ১২৪)

মুসলিম পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলাম নারীকে দিয়েছে অত্যন্ত সম্মানজনক মর্যাদা। ইসলামের শান্তিময় বিধান নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদার অধিকারী করেছে। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো রকম তারতম্য নেই। ইসলাম কখনো নারীকে চার দেয়ালে আবদ্ধ করেনি। নারীকে প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বা কর্মস্থলে যেতে হবে বলেই ইসলাম তার সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য পর্দার ব্যবস্থা অত্যাবশ্যকীয় করেছে।

   উম্মাহাতুল মুমিনীন (মহানবীর স্ত্রীগণ) তাঁদের কাছে আগত মহিলাদের ধর্মীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক প্রভৃতি বিষয়ে নৈতিক শিক্ষাদান করতেন। নবী করীম স. স্বয়ং নারীদের শিক্ষাগ্রহণের গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নারীদের উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক ভাষণ দিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞানর্জন করা ফরজ।’ (ইব্নে মাজা)

   আল্লাহ প্রদত্ত মানব মর্যাদা সম্পর্কে জানতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নারীদের শিক্ষা, চিন্তা-চেতনা, পাত্র নির্বাচন ও কর্মের স্বাধীনতাসহ সম্মতি প্রদানের অধিকার সর্বপ্রথম ইসলামই দিয়েছে। ইসলাম বিবাহের সময় অবিবাহিত মেয়েদের, তালাকপ্রাপ্তা এবং বিধবাদের মত-প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেছে। নারীরা আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজেদের নৈতিক চরিত্রকে সমুন্নত রাখবেন এবং সৎ ও ধার্মিক ব্যক্তিকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করবেন বিভিন্ন আয়াতে এমনই নির্দেশিত।

   সমাজে মাতা, গৃহকর্ত্রী ও ব্যবসাকর্মে নিয়োজিত নারীদের যথার্থ অবস্থান নিশ্চিত করে রাসূলুল্লাহ্ স. নারীর অধিকার সমুন্নত করে গেছেন। ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও মুক্তির জন্য যাবতীয় বৈষম্য, অজ্ঞতা ও অহংকার পরিত্যাগ করে সৎকর্মের দ্বারা পারস্পরিক সম্পর্কের মাপকাঠি নির্ধারণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।

   ইসলামে পিতামাতা, নিকটাত্মীয় ও স্বামীর সম্পত্তিতে রয়েছে নারীর সম্মানজনক অধিকার। যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে যে অর্থসম্পদ মহিলারা উপার্জন করবেন এবং উত্তরাধিকার সূত্রে যে ধনসম্পদের অধিকারী হবেন, এতে ইসলাম নারীকে দিয়েছে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। তবে এ সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সৎলোকের (পিতা, ভাই, স্বামী) পরামর্শ গ্রহণের জন্য ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক বা বেশি হোক, এক নির্ধারিত অংশ।’ (সূরা আন্-নিসা, আয়াত-৭)

   স্বভাবতই নারীরা এক নিবিড় পারিবারিক বন্ধন ছেড়ে স্বামীর গৃহে যায়। সিখানে গিয়ে যাতে মেয়েটি কোনো রকম নিরাপত্তাহীনতা অনুভব না করে, সে জন্য তার প্রতি স্বামীর সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন এবং যাতে পুরুষ এবং নারী তাদের প্রাপ্ত অধিকার এবং হকের বিনিময়ে সচেতনতা অবলম্বন করতে পারেন তাই স্বামী-স্ত্রীর প্রাপ্য সম্মান ও সমানাধিকার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে, ‘নারীদেরও (পুরুষদের ওপর) তদ্রƒপ অধিকার আছে, যদ্রুপ  নারীদের ওপর পুরুষদের অধিকার আছে বিধান অনুযায়ী।’ (সূরা আল্-বাকারা, আয়াত-২২৮)

   ইসলাম নারীকে সর্বক্ষেত্রেই অধিকার দিয়েছে বেশি আর পুরুষকে দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়েছে বেশি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আল্লাহ্ তাআলা পোশাকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পোশাকের সাথে শরীরের সম্পর্ক যত নিবিড়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ততটাই নিবিড় হওয়া চাই। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ।’ (সূরা আল্-বাকারা, আয়াত-১৮৭)

   নবী করীম স. স্বামীকেই অধিক ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমরা নিজ স্ত্রীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্কে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই আদেশ মতো তাদের তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ। মুমিন স্বামী ঈমানদার স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণকারী হবে না।  কারণ স্ত্রীর কোনো ব্যবহারে মনে কষ্ট এলেও পুণরায় তার দ্বারাই এমন ব্যবহার পাবে, যাতে সন্তুষ্টি লাভ হবে।’ (মুসলিম)

   ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়েরই ন্যায্য অধিকার ও সমমর্যাদা স্বীকৃত। যেমন--বাক্স্বাধীনতা, ভোটাধিকার ও সমালোচনার অধিকার। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগী, প্রতিযোগী নয়। পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়ই সংসারধর্ম পালন করবে এবং পারস্পরিক উন্নতির সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। স্বামী যেহেতু বাইরে চাকরী বা ব্যবসায় ব্যস্ত, সেহেতু ঘরে সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া ও চরিত্র গঠন করার মতো বিরাট দায়িত্ব স্ত্রীকেই পালন করতে হয়। ঘরের এ মূল দায়িত্বকে উপেক্ষা না করে কোনো নারী যদি সময়-সুযোগ, মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানজনক কোনো চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তবে তা অতি উত্তম। স্বামীর সংসারে কর্ত্রী হিসেবে নারীর দায়িত্ব নির্ধারণ করে রাসূল স. বলেছেন, ‘স্ত্রী তার স্বামীর পরিজনবর্গের এবং  সন্তানদের তত্ত্বাবধানকারিণী।’ (বুখারি ও মুসলিম)

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে নারীরা স্ব স্ব যোগ্যতা ও মেধার গুণে নিজেরাই কর্মসংস্থান করে নিচ্ছেন, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো নারীদের প্রতি রূঢ় আচরণ করা যেন মানুষের মজ্জাগত। নারী সহকর্মীকে প্রায়ই আপন করে নেওয়ার মনমানসিকতা হারিয়ে তাদের মানবিক প্রাপ্যটুকু ক্ষুণœ করা হয়, যা দেশ, জাতি বা নতুন প্রজন্মের উন্নতিতে বাধা দিচ্ছে। ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শ নারীকে বিভিন্ন বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তার অধিকারকে যে উঁচু মর্যাদায় উন্নীত করেছে, তা অন্য কোনো ধর্ম, আদর্শ বা মতবাদে সম্ভব নয়। অথচ সবার মধ্যে যে জিনিসটা এখনো রয়েছে তা হলো নারীদের সঠিকভাবে মর্যাদা না দেওয়া বা উপেক্ষা করা। নারীদের এমনভাবে কোণঠাসা করে না রেখে তাদের উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষায় অবারিত সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এজন্য আমাদের ধর্মীয় গোঁড়ামীর দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে হবে। ইসলাম প্রদত্ত নারীজাতির ন্যায্যপ্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কেই আন্তরিক হতে হবে। ইসলামে নারীদের যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে তা কড়ায়-গণ্ডায় আদায় হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নজরদারি বৃদ্ধিতে আলেম সমাজেরও এগিয়ে আসা উচিত।

[কলকাতার কট্টর নাস্তিক লেখক প্রবীর ঘোষের ‘‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’’ বইটির উত্তরে এই বইটি লেখা। ‍পুরো বই পড়ুন অনলাইনেই।

১ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post.html

২য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_27.html

৩য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_55.html

৪র্থ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_83.html

৫ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_32.html

৬ষ্ঠ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_31.html

শেষ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_42.html]



Post a Comment

0 Comments