আল্লাহ্ যদি সব সৃষ্টি করেন, আল্লাহকে সৃষ্টি করেছেন কে?
ছোট বয়সে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন প্রায়শই ঘুরপাক খেত। আমদেরকে, মানে আসমান, জমীন সবকিছু যদি আল্লাহ্ সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে আল্লাহকে সৃষ্টি করেছেন কে? আবার আল্লাহকে যদি কেউ সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে সে অজ্ঞাত স্রষ্টা কে এবং তাঁকে আবার সৃষ্টি করেছেন কে?........????
প্রবীর ঘোষের বই’র ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “যতদুর পর্যন্ত জানা যায়, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড শূণ্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। একটি বিশ্ব ছিল, যার মধ্যে ছিল তেজপূর্ণ প্রচন্ড শক্তি। ........ তারপর এক সময় ওই তেজঃপুঞ্জ বিস্ফোরিত হল। ....... সেই বিস্ফোরণের নাম দেয়া হয়েছে বিগ ব্যাং।”
আল্লাহর স্রষ্টা যদি আমরা খুঁজি, মানে সবকিছুর জন্য যদি স্রষ্টা আবশ্যক হয়, তাহলে প্রবীর ঘোষকে খুঁজে দিতে হবে ঐ ‘বিশ্ব’-এর (‘একটি বিশ্ব ছিল’ কথায় উল্লেখিত) স্রষ্টা। তিনি কি পারবেন খুঁজে দিতে? কখনোই না, তিনি যত উচ্চ মাপের ‘যুক্তিবাদী’ই হোন না কেন। আল্লাহর স্রষ্টা নেই বলে তিনি আল্লাহ্কে স্বীকার করেন না, তাহলে ঐ ‘বিশ্বে’রও যেহেতু স্রষ্টা নেই, সেহেতু তিনি ঐ ‘বিশ্ব’কেও অস্বীকার করতে হবে। আর ঐ বিশ্বকে অস্বীকার করা মানে তাঁর নিজেকেই অস্বীকার করা। এ সূত্রে তাঁকে স্বীকার করতে হবে যে, ‘আমি প্রবীর ঘোষ নামক কেউ নেই, কখনো ছিল না, কখনো থাকবেও না।’
হয়তো একমাত্র আল্লাহকে ধরে নিতে হবে আপনা আপনি সৃষ্ট; নয়তো মহাবিশ্বের শত শত, হাজার হাজার সার্থক, সুন্দর প্রয়োজনীয় সৃিষ্ট যেমন মানুষ, পশু-পাখি, ফুল-ফল, আলো-বাতাস-পানি, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, খনিজ তেল, লোহা, তামা, স্বর্ণ, রূপা এসব নিয়ে যে পরিপাটি মহাবিশ্ব, সেটাকে ধরে নিতে হবে আপনা-আপনি সৃষ্ট।
পরাক্রমশালী আল্লাহকে যদি আপনা-আপনি সৃষ্ট ধরে নেয়া হয়, তাহলে হিসেব মেলানো খুব সহজ যে, স্র্রষ্টা আপনা-আপনি আবির্ভাবের পর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করলেন পরিকল্পনা মাফিক। কিন্তু যদি অপরূপ সুসজ্জিত এ মহাবিশ্বকে আপনা-আপনি সৃষ্ট ধরে নেয়া হয়, তাহলে কঠিন হবে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া যে, মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় মহাবিশ্বের শত শত সৃষ্টি একত্রে (At a time) আপনা-আপনি সৃষ্টি হল কিভাবে? দু’একটা কিছু আপনা-আপনি সৃষ্টি হলে হতে পারে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া যেহেতু সৃষ্টি, সেহেতু বাতাস, পানি ইত্যাদি দু’একটা বস্তু ‘পরিকল্পনাহীন সৃষ্টি-তালিকা’ থেকে বাদ পড়ে গেলে মানুষের কী করার থাকত? সুতরাং মহাবিশ্বের বদলে আল্লাহকে আপনা-আপনি সৃষ্ট ধরে নিলে হিসাব মেলানো সহজ।
বর্তমান বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর “A Brief History of Time”গ্রন্থে লিখেছেন, “ভগবান আমাদের মত প্রাণী সৃষ্টি করবেন বলেই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি এভাবে করতে বাধ্য হয়েছিলেন।” [সূত্র: ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ পৃ-১০৭]
স্যার আইজাক নিউটন মনে করতেন, এ বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পেছনে অবশ্যই একজন ঈশ্বর রয়েছেন। তাঁর মতে, এ জগৎ বিশৃঙ্খলভাবে সৃষ্ট নয়। আর বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসাবে দেখা যায়। [সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ঢাকা, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১০]
আল্লাহর আগে কী ছিল?
মুসলিম পন্ডিত ইমাম আবু হানিফার রহ. শৈশবকালীন একটি কাহিনী আছে। সে সময় একজন নাস্তিক তিনটা প্রশ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। সে প্রচার করে বেড়াত, কেউ আমার তিনটি প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে আমি তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাস করব (ইসলাম গ্রহণ করব)। ঐ তিনটি প্রশ্নের একটি ছিল, ’ঈশ্বরের আগে কী ছিল?’ নাস্তিক হয়তো ভেবেছিল, তার প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। এজন্য তার আস্তিক হওয়ার আশংকাও নেই।
নাস্তিকের প্রচারণা শিশু আবু হানিফার কর্ণগোচর হল। আবু হানিফা এগিয়ে এলেন নাস্তিকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। অবশেষে একদিন জনসম্মুখে বিতর্কের আয়োজন করা হল। নাস্তিক যখন প্রশ্ন করল, ‘আল্লাহর আগে কী ছিল?’ তখন ইমাম আবু হানিফা বললেন, আপনি এক হতে ক্রমিক সংখ্যাগুলো পড়–ন তো দেখি। সে ১,২,৩,৪..... এভাবে ১০ পর্যন্ত যখন পড়ল তখন ইমাম আবু হানিফা বললেন, ঠিক আছে আর সামনে এগুতে হবে না, এবার ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে পড়–ন। নাস্তিক পড়তে লাগল, ১০,৯,৮,৭......। এভাবে ১ পর্যন্ত পড়ার পর থেমে গেল। ইমাম আবু হানিফা বললেন, থেমে গেলেন কেন, ১-এর আগে কী, পড়–ন। নাস্তিক বলল, কিভাবে পড়ব, ১-এর আগে তো কিছু নেই, শূণ্য। ইমাম আবু হানিফা বললেন আল্লাহ্ও একজন। তিনিই প্রথম (এক), তাঁর আগে কিছু নেই; ছিল না, শূণ্য। তাঁর আবির্ভাবের পর সব হয়েছে। আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ সহ অপরূপ নিয়মতান্ত্রিক এ মহাবিশ্ব তাঁর পরিকল্পনা এবং ইচ্ছানুযায়ী সৃষ্ট। তিনি এক, তাঁর পরে দুই, তিন, চার আমরা সব।
বিগ ব্যাং কি সত্যিই হয়েছিল?
ইতিপূর্বে উল্লেখ হয়েছে যে, ‘বিগ ব্যাং’ নামটাই ঠাট্টাচ্ছলে দেয়া হয়েছিল। স্রেফ একটা অজ্ঞাত বিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্ব নামক চমৎকার একটা জগৎ তৈরি হওয়ার ধারণাটা ঠাট্টার বিষয় ছাড়া আর কি! স্রষ্টাকে বিশ্বাস করতে বা মেনে নিতে যাদের কষ্ট হয়, তারা বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আর কোনো উৎস খুঁজে না পেয়ে একটা কিছু বাজারে ছেড়ে দিল আর কি। তারা কি বলতে পারবে ট্রিলিয়ন ডিগ্রী তাপে অতি চাপযুক্ত যে পদার্থগুলো বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টির গল্প তারা বর্ণনা করে, সে পদার্থগুলো এলো কোত্থেকে? যাহোক এ সম্পর্কে কথা আর না বাড়িয়ে সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের দু’জন বিজ্ঞানীর Big Bang -সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছিঃ
ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালের কন্ঠে’র ৬ এপ্রিল ২০১০ইং সংখ্যায় ‘বিগ ব্যাং আদৌ হয়নি?’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়।
বিগ ব্যাং আদৌ হয়নি?
কালের কণ্ঠ ডেস্ক
“যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দু’জন বিজ্ঞানী বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত বিগ ব্যাং তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, বিগ ব্যাং তত্ত্বের ভেতর বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির ব্যাখ্যা টিকে থাকার রসদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ভারতের পরিসংখ্যান ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের অশ্বিনী কুমার লাল এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ব্রেইন রিসার্চ ল্যাবরেটরির রাউন জোসেফ এ বিষয়ে দু’টি গবেষণাপত্র লিখেছেন, যা মহাকাশবিজ্ঞানসংক্রান্ত বিখ্যাত সাময়িকী হার্ভার্ড জার্নালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
অশ্বিনী তাঁদের এ গবেষণাপত্র দু’টি সম্পর্কে বার্তা সংস্থাকে জানান ‘বিগ ব্যাং (মহাবিস্ফোরণ) তত্ত্বের ওপর সন্দেহের ছায়া ফেলেছে তাঁদের গবেষণা। বিজ্ঞান মহল এখন এর মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মান্ড সূচনালগ্নের বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখতে পারবে।’
তাঁর মতে ১৩৭৫ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং ঘটে থাকলে সে সময় বিশ্বব্রহ্মান্ডে আর কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু তখনো কয়েকশ’ কোটি বছরের পুরনো গ্যালাক্সির অস্তিত্ব ছিল। আকার এবং ব্যাপ্তিতেও এসব গ্যালাক্সি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত তাঁর গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান তিনি ।
‘বিগ ব্যাং? এ ক্রিটিক্যাল রিভিউ’ নামের এ গবেষণাপত্রে তিনি এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ‘১৩৭৫ কোটি বছর আগেও মহাবিশ্বে বিকাশমান কিছু পদার্থের অস্তিত্ব ছিল, সুতরাং সে সময় বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সূচনা ঘটেছিল--এ কথা আমরা কী করে বলি?’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এমন দিন খুব তাড়াতাড়ি আসতে পারে যখন স্বীকার করতে হবে বিগ ব্যাংয়ের ঘটনা আদৌ ঘটেনি। ভবিষ্যতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বরং বিস্ময়ে ভাবতে পারেন, তথ্য-উপাত্তের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কী করে বিজ্ঞানীরা এমন একটি বৈপরিত্যেভরা উদ্ভট তত্ত্ব বিশ্বাস করত!’
১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বে অভিকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন। সে তত্ত্ব অনুযায়ী বিগ ব্যাংয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে এ অভিকর্ষ তরঙ্গ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির তিন লাখ আশি হাজার বছর পর প্রথম কসমিক মাইক্রোওয়েভ বিগ ব্যাং থেকে উদ্ভূত হয় বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু অভিকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব বিগ ব্যাংয়ের প্রথম মিনিট থেকে পাওয়া যায়।
বিগ ব্যাং তত্ত্বে বিশ্বাস করা হয়, বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে বিশাল আকারে অভিকর্ষ তরঙ্গের স্রোত বিশ্বব্রহ্মান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ তরঙ্গ মহাবিশ্বের স্থান ও সময়ের চাদরের ওপর মৃদু দোলা দিয়ে যায়। এ অভিকর্ষ তরঙ্গ এখনো বিশ্বব্রহ্মান্ডের দূরদূরান্তে ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও এ তরঙ্গ খুবই দুর্বল এবং প্রচলিত জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসন্ধান যন্ত্র দিয়ে শনাক্ত করা দুরূহ, তারপরও এ তরঙ্গ এমন কিছু তথ্য বহন করছে, যা থেকে জানা যায় এটি বিগ ব্যাংয়ের শুরু থেকেই প্রবাহমান।
অশ্বিনী কুমারের ওপর ভিত্তি করেই বিগ ব্যাংয়ের ওপর প্রশ্নরেখা এঁকে দিয়েছেন বলে মনে করেন।” [সূত্র: এএফপি। প্রকাশিত হয় কালের কন্ঠে]
মহাবিস্ফোরণ স্রষ্টার সৃষ্ট কিছু নয়
০৮ জানুয়ারি ২০১১ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক প্রথম আলো’য় “মহাবিস্ফোরণের পেছনে স্রষ্টার হাত ছিল : পোপ” শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটিতে পোপের যেসব ‘প্রত্যক্ষ উক্তি’ উল্লেখ করা হয়েছে, সেসবে স্রষ্টার অস্তিত্বের সপক্ষে পোপের জোরালো সমর্থনের উল্লেখ আছে বটে; তবে শিরোনাম-মতে মহাবিস্ফোরণ-সমর্থনের উল্লেখ নেই, বরং আছে মহাবিস্ফোরণ অস্বীকারের কথা! যেমন, পোপ বলেন, ‘মহাবিশ্ব কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে সৃষ্টি হয়নি। অনেকেই আমাদের এমন বিশ্বাস করাতে চাইছেন। মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের সামনে স্রষ্টার প্রজ্ঞা এবং তাঁর অসীম সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে।’
পোপ বলেন, ‘কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে “সীমিত চিন্তার” ফসল। কারণ এসব তত্ত্ব কেবল নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে...এবং এসব তত্ত্ব বাস্তবতার নিরিখে চূড়ান্ত কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘মহাবিশ্ব ও মানবজাতির সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যেসব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যায় না। শুধু ঈশ্বরের প্রতি, স্বর্গ ও নরকের স্রষ্টার প্রতি নিজেদের নিবেদিত করার মাধ্যমে আমরা এই বিশ্বের রহস্য ও মাহাত্ম্যের সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে পারি।” [বিস্তারিত : প্রথম আলোয়]
সুতরাং এ পরিকল্পিত মহাবিশ্ব আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন স্বীয় পরিকল্পনামতে; অপরিকল্পিত অজ্ঞাত একটি বিস্ফোরণের ফসল নয় এ মহাবিশ্ব।
ভারতের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অরুণকুমার শর্মা বিশ্বাস করেন, ‘পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে মানুষের সৃষ্টি-- সবের মধ্যেই রয়েছে একটা পরিকল্পিত পরিকল্পনা।’ [সূত্র: ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’, পৃ-৯৬]
প্রথম দু’মানবের আগমন আল্লাহর পক্ষ থেকেই
প্রথম দু’মানবের আবির্ভাবের উৎস নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বানর থেকে মানুষের আবির্ভাব কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়, তেমনি বিগ ব্যাং-এর ফসল হিসেবে মানুষের অভ্যুদয় ঘটার ধারণাও মেনে নেয়া কষ্টকর। কারণ এ দু’পন্থায় মানুষের সৃষ্টি হলে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও এখনো মানবসমাজে মাঝে মাঝে বংশ-পরিচয়হীন নতুন নতুন মানুষের উদয় হতো। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে এ ধরনের ঘটনা ঘটা তো দূরের কথা, বিগত হাজার বছরের ইতিহাসেও এ ধরনের কোনো গল্পগুজবের বর্ণনা নেই।
বিশ্বজগৎ আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন মানুষের বসবাসের উপযোগী করে এবং তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানবজাতি, যাদের শুভ-সুচনা হয়েছিল আদম এবং হাওয়া নামক বিপরীত লিঙ্গের দু’সদস্যের মাধ্যমে।
আর মানব জাতিকে মহাণ আল্লাহ্ অপরাপর সৃষ্টি থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। অন্য সকল সৃষ্টিকে মানবজাতির বশীভূত করে দিয়েছেন। ফলে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু থেকে মানুষ উপকার লাভ করতে পারে। মানুষকে তিনি অন্য কোনো সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত করেননি। মানুষের প্রতি তাঁর নির্দেশনা হল, ‘তোমরা আমার অনুগ্রহ ভোগ কর আর আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (আল্-কোরআন)
আল্লাহ্কে দেখা যায় না, আল্লাহর অস্তিত্ব টেরও পাওয়া যায় না?
পবিত্র কোরআন শরীফে আছে, ‘কোনো চোখ তাঁকে (আল্লাহ্কে) দেখতে পায় না।’ [সূরা আন্আমঃ ১০৩] এটা আল্লাহর একটি বৈশিষ্ট্য।
বিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে ছাত্রদেরকে প্রশ্ন করি, ‘তোমরা কি আলো দেখতে পাও?’ ওরা জবাব দেয়, ‘জ্বি স্যার, আলো আমরা দেখি।’ বলি, ‘আমাকে একটু দেখাও তো।’ ওরা বলে, ‘কখনো কখনো কোনো ছিদ্র দিয়ে যখন রোদ প্রবেশ করে তখন একটি সরলরেখার মতো রোদ দেখা যায়।’ এরপর যখন বলি যে, ‘তোমাদের ক্লাসরুমে কি এখন আলো আছে?’ ওরা বলে, ‘আছে।’ ‘তোমরা কি দেখতে পাও?’ এ প্রশ্নের জবাবে ওরা নির্বাক হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আলো দেখা যায় না। আলো দ্বারা অন্য বস্তু কেবল দেখা যায়। ছিদ্রপথে কখনো আলো প্রবেশ করলে যে আলোক-রেখা দেখা যায়, তা কিন্তু আলোর শরীর নয়। তা হচ্ছে ছিদ্রপথের আলো দ্বারা দৃশ্যমান ধুলোবালি। এজন্য ধুলোবালি যেখানে নেই সেখানে ছিদ্রপথে প্রবেশ করা আলোক রেখাটিও দৃষ্টিগোচর হয় না।
আলো দেখা যায়না, তাই বলে কি আলো সত্য নয়, আলোর অস্তিত্ব নেই? আমরা কখনো কখনো কথা প্রসঙ্গে বলে থাকি, ‘দিবালোকের মত সত্য’, আলোর অস্তিত্ব আছে বলেই। আমরা মূলতঃ আলোর ফলাফল বা পরিণতি থেকেই আলোর অস্তিত্ব অনুভব করি।
বিজ্ঞান বলে, আকাশের রঙ নাকি নীল নয়। আমরা আকাশের দিকে তাকালে যে নীল রঙ দেখি, তা কিন্তু আকাশের রঙ নয়। কারণ আকাশ যে দূরত্বে অবস্থিত, সে দূরত্বে আমাদের খালি চোখ দিয়ে আকাশ দেখা সম্ভব নয়। তাই বলে কি আকাশ নেই? সাধারণ-জ্ঞানের অধিকারি এমন একজনও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যে আকাশের অস্তিত্ব অস্বীকার করে।
প্রাণ আছে বলেই আমরা প্রাণী। বিশাল একটি পাথর, শুধুমাত্র প্রাণ নেই বলে নড়াচড়া, হাঁটাচলা করতে পারে না। অথচ একটি পিঁপড়া প্রাণ আছে বলেই সচ্ছন্দে সুন্দর জীবন যাপন করে। বিশাল তিমিও একটি প্রাণী। যদি প্রশ্ন করা হয় তিমির প্রাণ থাকে কোথায়? কোথায় থাকে? থাকে তার পুরো শরীর জুড়ে। কিন্তু তা কি দেখা যায়? একটি তিমিকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে টুকরো করে ফেললেও কি তার প্রাণ খুঁজে পাওয়া যাবে? প্রাণ দেখা যায় না বলে একটি জীবন্ত তিমিকে কি নিষ্প্রাণ বলার মত মূর্খতা কেউ করতে পারে?
আমাদের মানুষের কথাই বলি। আমাদের পুরো শরীর জুড়েই প্রাণ বিরাজমান। এজন্য প্রাণ চলে গেলে পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। পুরো শরীরে বিরাজমান এ প্রাণ কি কেউ কখনো দেখতে পেয়েছে? দেখতে পায়নি বলে কি বলতে হবে প্রাণ নেই? দেখা যায় না বলে কি প্রাণে বিশ্বাস করা ভুল হবে?
ছোট্ট একটি গল্প আছে। এক বিজ্ঞান শিক্ষক ছাত্রদের বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন। কথাপ্রসঙ্গে একদিন ছাত্রদের বললেন, ‘আমরা যা দেখতে পাইনা তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা উচিত নয়। যেমন আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই না, এজন্য আমরা কিভাবে তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি?’ যুক্তিটি ছাত্রদের বেশ মনঃপুত হল। যুক্তির কাছে ওদের বিশ্বাস হার মানলো। কিন্তু একটা ছাত্র কিছু একটা বলার জন্য হাত তুলে দাঁড়াল। শিক্ষক বললেন, ‘তুমি কি কিছু বলবে?’ ছাত্র বলল,‘জ্বী, স্যার।’ শিক্ষক ভাবলেন, কী আর বলবে। বললেন, ‘ঠিক আছে, কি বলবে বল।’ ছাত্র বলল, ‘স্যার, আপনি কি কথাটা সজ্ঞানে বলেছেন নাকি অজ্ঞানে বলেছেন?’ শিক্ষক বললেন, ‘আমি সজ্ঞানেই বলেছি।’ ছাত্র বলল, ‘কখনোই না স্যার, আপনি কথাটা অজ্ঞান অবস্থায় বলেছেন। কারণ আপনার জ্ঞান-ই তো নেই!’ শিক্ষক বললেন, ‘আমার জ্ঞান নেই মানে?’ ছাত্র বলল,‘আপনার জ্ঞান থাকলে আমাদের দেখান।’
বিদ্যুৎ দেখা না গেলেও বিদ্যুতের ক্রিয়া দেখা যায়।
আমরা নানান কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকি। বিদ্যুৎকে বলা যায় আধুনিক সভ্যতার প্রাণ। কিন্তু বিদ্যুৎ দেখা না যাওয়া সত্ত্বেও আমরা জীবনের অত্যাবশ্যকীয় অনেক প্রয়োজনে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ কাজে লাগাই। আমরা দেখি, বিদ্যুৎ থাকা অবস্থায় বাতি জ্বলে, পাখা ঘুরে, মিল-কারখানা চলে। কিন্তু এগুলো কি বিদ্যুৎ? এগুলো হলো বিদ্যুতের ক্রিয়া বা ফল। এক্ষেত্রে আমাদেরকে ফল দেখেই কেবল বিদ্যুতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে হয়।
আমরা আল্লাহ্কে দেখিনা ঠিক, কিন্তু আল্লাহর অনেক ক্রিয়াকর্ম দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই আল্লাহ্ চাঁদ-সূর্য-পৃথিবীকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিচালিত করছেন, মানুষকে সৃষ্টি করছেন, মানুষকে মৃত্যু দিচ্ছেন, বায়ু প্রবাহিত করছেন, বৃষ্টি দিচ্ছেন, মানুষকে অপরাপর সৃষ্টি থেকে উপকার লাভের সুযোগ দিচ্ছেন।
দেয়ালের এপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে ওপাশ থেকে ধোঁয়া উঠছে। এখন ওপাশে আগুন আছে বিশ্বাস করা কি ভুল হবে? আর এ বিশ্বাস কি “অন্ধবিশ্বাস”? কেউ যদি এ ধরনের বিশ্বাসকে “অন্ধবিশ্বাস” বলতে বলতে গলা ফাটিয়ে ফেলে, আমাদের দ্বিধা নেই। আমরা জানি এ বিশ্বাসে কোনো খাদ নেই, ভেজাল নেই। কেউ মুখের জোরে এ বিশ্বাসকে “অন্ধবিশ্বাস” বললেও এ বিশ্বাসই সত্য। কারণ আগুন ছাড়া কখনো ধোঁয়া হতে পারে না।
[কলকাতার কট্টর নাস্তিক লেখক প্রবীর ঘোষের ‘‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’’ বইটির উত্তরে এই বইটি লেখা। পুরো বই পড়ুন অনলাইনেই।
১ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post.html
২য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_27.html
৩য় পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_55.html
৪র্থ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_83.html
৫ম পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_32.html
৬ষ্ঠ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_31.html
শেষ পর্ব: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post_42.html]
0 Comments